করোনা মহামারি ও কিছু পর্যবেক্ষণ
১৯ জুন ২০২০এই মহাতাণ্ডবের কারণে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সত্যিকারের অবস্থাও আমরা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছি৷
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়৷ এর মধ্যে শতাধিক দিন অতিক্রান্ত হয়েছে৷ এপর্যন্ত প্রায় পৌনে ছয় লাখ রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, যা ষোল কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ বিবেচনায় খুবই কম৷ তাই এ থেকে প্রাপ্ত শনাক্তের সংখ্যা দিয়ে সারাদেশে করোনার সত্যিকার বিস্তৃতি এবং গভীরতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়৷ তবে শনাক্ত হওয়া সংখ্যাটিকে আমরা সমুদ্রজলে ভাসমান হিমশৈলীর সাথে তুলনা করতে পারি৷ এর বারো ভাগের একভাগ মাত্র ভাসমান ও দৃশ্যমান থাকে৷ বাকি এগারোভাগ জলের ভিতর ডুবন্ত ও অদৃশ্যমান রয়ে যায়৷ তারমানে শনাক্ত কোভিড-১৯ আক্রান্তের চেয়ে সত্যিকারের আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি৷ দেশের হাসপাতালগুলোতে বেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে৷ আইসিইউর বেড প্রায় দুর্লভ৷ দেশের শীর্ষস্থানীয় বিত্তবান পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ আইসিইউর পূর্ণ সেবা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন৷ শয্যা না পেয়ে রোগী হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে৷ পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করার মতো দুঃখজনক ঘটনাও বেশ কিছু ঘটেছে৷
এই অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ কেমন আছে? কোভিড-১৯, জীবন, জীবিকা ও চিকিৎসা নিয়ে তাদের ভাবনা কেমন? বাংলাদেশে একটি বিত্তবান শ্রেণি আছে৷ সাধারণ সময়ে এরা হাঁচিকাশি বা সাধারণ মেডিকেল চেক-আপের জন্য দেশের বাইরে চলে যেত৷ শাসন ক্ষমতার সাথে যুক্তগণ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও নানা বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয়রাও পরিবারসহ নিজেদের রোগের চিকিৎসা সাধারণভাবে বিদেশেই করে থাকে৷ দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার দিকে তারা কেউ এতদিন নজর দেয়নি৷ কিন্তু কোভিড-১৯ সমস্ত দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে৷ বিদেশেযাত্রার সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ যদিও কতিপয় ‘অতিবৃহৎ ব্যক্তি' চার্টার্ড প্লেনযোগে দেশত্যাগ করেছে৷ বাংলাদেশের এইসব মানুষেরা নানাভাবে নিজেদের মধ্যে জালের মতো যুক্ত৷ করোনার এই কালে এরা সকলেই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন৷ এদের হাহাকার ধ্বনি কান পাতলেই শোনা যায়৷ বিত্ত, ক্ষমতা ও অবস্থানের ত্রিদলীয় জোটের সদস্যরা দেশের ভিতরে চিকিৎসাসেবার উন্নত ও বিলাসবহুল জায়গাগুলো দখলে নেয়া শুরু করে৷ ফলে এসব স্থানে যারা আগে সেবা গ্রহণ করতেন তাদের স্থানচ্যুতি ঘটে৷ স্থানচ্যুত এই অংশটির ভিতর আরেক ধরণের কষ্ট, হতাশা ও স্বাস্থ্য-অনিশ্চয়তা তৈরি হয়৷
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের একটি উল্লেখযোগ্য জনবৈশিষ্ট্য হলো, চাষাবাদের সাথে যুক্ত মানুষ, রিক্সাচালক, খোলা জায়গায় কাজ করা শ্রমিক, বস্তিবাসী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীতে আক্রান্তের হার প্রায় নগণ্য৷ ঢাকার সীমান্তবর্তী একটি জেলা মানিকগঞ্জ৷ এই জেলার এক উপজেলার নাম হরিরামপুর৷ পদ্মা নদীর তীরবর্তী হরিরামপুরে ২৯ জন মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত৷ এই ২৯ জনের অধিকাংশই ঢাকা থেকে গিয়েছেন৷ রোগাক্রান্ত একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে তার সংস্পর্শে তিনজন ডাক্তার আসেন৷ তারা পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত হন৷ ডাক্তারদের সাথে কর্মরত একজন নার্সও করোনা রোগী হিসাবে শনাক্ত হয়৷ বাকি একজন গৃহবধূ যার স্বামী ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চাকরি করেন৷ প্রয়াত এই নারীটি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন৷ তার স্বামী ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার পরই রোগীর জ্বর শুরু হয়৷
টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ জন৷ ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে ভাইরাসবাহী ব্যক্তি ও গার্মেন্টস কর্মী এলাকায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ চিকিৎসার জন্য এক ব্যক্তি উপজেলা হাসপাতালে যায়৷ সেখানে এক প্যাথলজির টেকনোলজিস্ট তার রক্তগ্রহণ করে৷ পরে সেও করোনা পজিটিভ হয়৷ তার থেকে সংক্রমিত হয় একজন মোবাইল টেলিফোন মেকানিক৷ এই দুটি উপজেলার কোনো কৃষিজীবী মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়নি৷ এই চিত্রটি কমবেশি সারা দেশের৷ গ্রামের মানুষের ভাষায় করোনা হলো শহরের অসুখ৷
বাংলাদেশের মোট করোনা আক্রান্ত মানুষের কমবেশি এক-তৃতীয়াংশ বৃহত্তর ঢাকায় বাস করেন৷ ঢাকার রিক্সাচালকদের মধ্যে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বিরল৷ তাদের ধারণা করোনা বড়লোকদের বা টাকাওয়ালাদের অসুখ৷ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বস্তিবাসী মানুষের মধ্যে করোনা সংক্রমণ অত্যন্ত কম৷ প্রথমে ধারণা করা হয়েছিলো করোনা আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় বস্তিবাসী মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ কারণ তাদের বসবাসের স্থান অস্বাস্থ্যকর৷ এরা একটি ঘরে গাদাগাদি করে অনেকে বাস করে৷ কিন্তু সেটা ঘটেনি৷ ঢাকার কড়াইল বস্তি, কল্যাণপুরের পোড়াবস্তি অথবা মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ বস্তি সব জায়গাতেই একই চিত্র৷ বস্তিবাসীরা করোনাকে বড়লোক ও শিক্ষিত লোকের রোগ মনে করে৷ শ্রমজীবী মানুষের অধিকাংশ যারা খোলামেলা পরিবেশে কাজ করে তাদের মধ্যে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কম৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথমবার বিত্তবান ক্ষমতাবানেরা চাষাভুষা শ্রমজীবী মানুষকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছে৷
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের তীব্রতা কম বলে প্রতীয়মান হচ্ছে৷ নির্ণীত কোভিড-১৯ রোগীর ৮০ শতাংশ বাস করে দেশের ২০ শতাংশ স্থানে৷ বাকি ২০ শতাংশের বাস দেশের বাদবাকি অঞ্চলে৷ পর্যবেক্ষণ থেকে বেরিয়ে এসেছে দিনরাতের অধিকাংশ সময় যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ও কৃত্রিম আলোর নীচে বাস করে তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বেশি৷ এই শ্রেণির মানুষেরা শারীরিক শ্রম অথবা শরীরচর্চা কম করেন৷ মুক্ত বাতাসে, রোদের নীচে ভেজা মাটিতে নগ্ন পা লাগিয়ে হাঁটা এদের হয়ে উঠেনা৷ ফ্রিজে সংরক্ষিত ফলমূল, শাকসবজি ও খাদ্যগ্রহণের বিষয়টি এই পর্যবেক্ষণে যুক্ত হবে৷ শ্রমিকদের মধ্যে যারা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে দীর্ঘক্ষণ কাজ করে তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ তুলনামূলক বেশি৷ রিক্সাচালকদের চেয়ে গার্মেন্টস কর্মীদের মধ্যে করোনারোগী বেশি৷
অন্যদিকে নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে এই হার কম৷ হালচাষের সাথে সরাসরি যুক্ত মানুষের মধ্যে করোনার হার একেবারেই কম৷ এই কৃষক অথবা রিক্সাচালকের একটি ভাই মধ্যপ্রাচ্যে বা ইউরোপে অভিবাসী শ্রমিক হিসাবে কাজ করে৷ তাদের কিন্তু করোনা বেশি হচ্ছে৷ এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হলো, চাষীর জীবন ত্যাগ করে অভিবাসীর জীবন গ্রহণের মধ্য দিয়ে জীবনযাপনের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং সেই জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কৃত্রিমতায় অধিকতর সমর্পিত৷
এই পর্যবেক্ষণ থেকে একটি অতি প্রাথমিক সিদ্ধান্ত আসা যায়৷ সেটা হলো প্রাকৃতিক রোদ, বাতাস, মাটির পরিবেশে তাজা ফলমূল, শাকসবজি ও খাবার খেয়ে যারা পরিশ্রমী জীবনযাপন করেন তারা তুলনামূলকভাবে বেশি কোভিড-১৯ প্রতিরোধী৷ অবশ্যই এই পর্যবেক্ষণটি বৃহত্তর ও বহুকেন্দ্রিক সমীক্ষা ও গবেষণার দাবি রাখে৷