কত অজানা রে! গরু তুলা খেতে পছন্দ করে!
২৩ জুন ২০২৩কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই তিনি একাজটি শুরু করেন। গরু দেখাশোনার জন্য নিয়োগ করেন স্থানীয় অভিজ্ঞ কয়েকজন লোককে। ভদ্রলোক আমার পরিচিত, সেই সুবাদে আমাকে একদিন সেখানে নিয়ে গেলেন। ঘুরে ঘুরে গরুগুলো দেখালেন। বললেন, এগুলোকে ছয়-সাত মাস লালন পালন করে ঈদের আগে আগে বিক্রি করে দেবেন। আমি যে আজন্ম শহুরে মানুষ তা নয়, শৈশব আমার গ্রামেই কেটেছে। তাই গরু লালন-পালন কিছুটা বুঝি। কিন্তু এই খামারটিতে যেয়ে আমার কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হলো। এখানেই আমি প্রথম দেখলাম গরুকে তুলা খাওয়ানো হয়। খড়ের সঙ্গে তুলা মেশানোর দৃশ্য আমাকে কিছু অবাক করল। গরু যে তুলা খায়-এটাই আমার জানা ছিল না!
লালন পালনের দায়িত্বে যারা আছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, খাদ্য হিসাবে গরু কি তুলা পছন্দ করে? এটা তো পুরোই শুকনো জিনিস। তাদের তাৎক্ষণিক জবাব, খড়ও তো শুকনো। খড় যেমন ভিজিয়ে দিই, তুলাও তেমনি দেওয়া হয়। খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিই। খড়ের চেয়ে তুলা-ই বেশি পছন্দ করে ওরা।
তারা জানালেন গাজীপুর এলাকায় অনেকগুলো গার্মেন্টস, স্পিনিং মিল আছে। সেখান থেকে অব্যবহৃত তুলা তারা সংগ্রহ করে। খড়ের চেয়ে তুলার দামও অনেক কম পড়ে। এই এলাকায় যত লোক গরুর খামার করে, সবাই তাদের গরুর প্রধান খাদ্য হিসাবে তুলা দিয়ে থাকে। আর খড়, তুলার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ মিশিয়ে দেওয়া হয় খইল, ভুষি, কুড়া এসব।
সেই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কদিন আগে কথা হলো। জানতে চাইলাম, এবার গরু পালন করছেন কি-না। তিনি জানালেন, একবারেই তার শখ মিটে গেছে। ছয়-সাত মাসে একএকটি গরুর পিছনে যে পরিমাণ ব্যয় হয়, শেষে বিক্রি করতে যেয়ে লাভ দূরে থাক আসল তুলতেই হিমশিম খেতে হয়। মাঝখান থেকে শ্রমটুকুই নষ্ট। তিনি বললেন, তবে ব্যবসাটা বুঝে গেছি। দূরে থেকে কেবল লোক দিয়ে এক কাজ হবে না। নিজেকে ইনভলব থাকতে হবে। তাছাড়া গো-খাদ্যের দামও এখন অনেক বেড়ে গেছে। সে অনুপাতে বাড়েনি গরুর দাম।
এই যে শেষের কথাটা, গো-খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে, এটা এখন খামারিদের যেন একটি আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে। যে কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, গরুর দাম বৃদ্ধির কারণ হিসাবে গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কথাটা বলবেই। এটা যে খুব একটা ভুল কথা, তাও নয়। আসলেই অনেকটা দাম বেড়ে গেছে গো-খাদ্যের। আগে গ্রামে আমরা গরু লালন-পালনের যে দৃশ্য দেখতাম, গরুগুলো বেড়ে উঠতো প্রাকৃতিকভাবে, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। গো-চারণের জন্য খোলা মাঠই আর এখন পাওয়া যায় না। ফলে তাদের পুরো খাদ্যটাই সংগ্রহ করতে হয়।
এভাবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে গরুর দামেও। কোরবানির সময় ঘনিয়ে এলেই বাড়তে থাকে গরুর দাম। অর্থনীতির একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে-কোন কিছুর দাম নির্ভর করে
সরবরাহ ও চাহিদার অনুপাতের ওপর। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে যাবে। কিন্তু এই সাধারণ নিয়মটি সম্ভবত কাজ করে না কোরবানির পশুর বিষয়ে। গত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিবারই চাহিদার তুলনায় পশু বেশি থাকে। কিন্তু তারপরও দাম কমে না, বরং বেড়ে যায়।
সরকারি হিসাবে, গেল বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল এক কোটি ২১ লাখ। এর বিপরীতে কোরবানি হয়েছে ৯৯ লাখ। অর্থাৎ, ২২ লাখ পশু বাজারে বিক্রিই হয়নি। প্রতি ৫টি গরুর মধ্যে একটি বিক্রি হয়নি। এবছরের দৃশ্য কমবেশি একই রকম। এবার সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে এক কোটি তিন লাখ ৯৬ হাজার। আর বাজারে প্রস্তুত আছে এক কোটি ২৫ লাখেরও বেশি পশু। অর্থাৎ কোরবানির পর হয়তো দেখা যাবে ২১ লাখেরও বেশি পশু বিক্রিই হবে না। কোরবানির জন্য এই যে এত পশু, তারপরও দাম কিন্তু কমছে না। যে কোনো ব্যবসায়ী কিংবা ক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করুন, উত্তর মিলবে-এবার দাম চড়া। গত বছরের তুলনায় এবার কোরবানির পশুর দাম বেশি।
কোরবানির পশুরযে হিসাবটা এখানে ধরা হয়েছে, সেখানে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া সবই আছে। আলাদাভাবে হিসাব করতে গেলে এই এক কোটি ২৫ লাখের মধ্যে ৪৮ লাখই গরু ও মহিষ। তবে মহিষের সংখ্যা খুবই কম, সিংহভাগই গরু। সংখ্যার হিসাবে ৪৮ লাখ, অর্থাৎ মোট পশুর অর্ধেকেরও কম হলেও টাকার অঙ্কে সিংহভাগই কিন্তু এখানেই ব্যয় হয়। কারণ একটি গরুর দাম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। আমরা যদি গরুগুলোর গড় দাম ৭০ হাজার টাকা ধরি তাহলে ৪৮ লাখ গরুর দাম দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ছয়শ' কোটি টাকা। গরু বাদে কোরবানির অন্য পশুর মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে ছাগল। এসব ছাগলের গড় মূল যদি ২০ হাজার টাকা করে হয়, তাহলে এখাতে মোট মূল্যমান হয় ১৫ হাজার চারশ' কোটি টাকা। সবমিলিয়ে ৪৯ হাজার কোটি টাকা। এসবের সঙ্গে কোরবানির পশুর পরিবহণ ব্যয়, হাটের হাসিল, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, সবমিলিয়ে হিসাব করলে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
আমাদের দেশে গরুর খামার আসলে একটা বিশাল সেক্টর। এই যে আমরা ৫০ হাজার কোটি টাকার একটা হিসাব দিলাম, এটা কেবল কোরবানি কেন্দ্রিক গরু বেচা-কেনার হিসাব। এখানে দুধেল গাইয়ের হিসাব ধরাই হয়নি। ধরা হয়নি সারা বছরের গো-মাংসের হিসাবও। তবে কোরবানির সময়টা একক ঘটনা হিসাবে অনেক বড়। এর সঙ্গে মাংস ছাড়াও ধর্মীয় বিষয়টি জড়িত বলে অনেকের মধ্যে একটা আবেগও কাজ করে। আবেগের কারণে কোরবানির গরু কিনতে যেয়ে কেবল মাংসের হিসাবটাই গুরুত্বপূর্ণ হয় না। অনেক সময় গরুর রঙ, চেহারা, আকার, আকৃতি-এসবও বিবেচিত হয়।
আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, কোরবানির গরু কেনা যেন একটা উৎসবের মতো। হাট থেকে গরু কিনে আনার পর, ঈদের আগ পর্যন্ত বাড়িতে সেটাকে দিন কয়েক লালন পালন নিয়েও নানা আয়োজন থাকত। ঢাকা শহরে অবশ্য এই দুতিন দিনের লালন-পালন একটা বড় যন্ত্রণা হয়ে দেখা দেয়। এসব সমস্যা নিরসনেও নতুন একটা প্রবণতা ইদানিং দেখা যাচ্ছে। গরু কিনে আর বাসায় নিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ছে না। খামারে যেয়ে গরু কিনে সেখানে রেখে এলে, ঈদের দিন সেটা খামারের লোকজন বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এরকম একজনের সঙ্গে কদিন আগে কথা হলো। তাদের বাসা ইন্দিরা রোড। জানালেন, মানিকগঞ্জের এক খামার থেকে আরও দুসপ্তাহ আগে তারা গরু কিনেছে। নিয়মটা হচ্ছে-তারা গরু পছন্দ করে রেখে এসেছে। দামটা হবে ওজন হিসাবে। প্রতি কেজি ৫৫০ টাকা। যেদিন গরু ডেলিভারি দেওয়া হবে, সেদিন জীবন্ত গরুটিকে ওজন করা হবে। যে ওজন হবে, ৫৫০ টাকা কেজি দরে তার দাম পরিশোধ করা হবে। খামারগুলোতে ওজনের পাশাপাশি কিছু গরু দরদাম করেও বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে বড় গরু, যেগুলোর ওজন সাড়ে চারশ' কেজির চেয়ে বেশি হয়, সেগুলো দরদাম করে বিক্রি হয়।
এই যে খামার থেকে সরাসরি কিনে আবার সেখানেই রেখে আসার প্রবণতা, এটা বেশি দেখা যায় ঢাকা বা তার আশপাশের এলাকাগুলোতে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বা দূরবর্তী এলাকার খামারিদের নির্ভর করতে হয় পাইকারদের ওপর। পাইকাররা সেখান থেকে গরু কিনে নিয়ে যায় ঢাকায়। ফলে খামারিরা প্রায়ই বিঞ্চিত হয়, কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। মোটাতাজা করে
বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে যারা খামার করেন, তাদের জন্য লক্ষ্য তো থাকে একটাই-ঈদ উল আযহা। এই দিনটি পার হয়ে গেলে আবার এক বছরের অপেক্ষা। এই অপেক্ষাও আবার কেবল অপেক্ষাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে পুরো এক বছর গরুকে লালন-পালন করার বিপুল ব্যয়। ফলে খামারিদের অনেক সময় পাইকারদের কাছে অসহায় হয়ে পড়তে হয়ে। দেশের প্রতিটি জেলায় উপজেলায় সরকারের পশুপালন বিভাগ রয়েছে। খামারিদের গরুর বিপননে তাদের যে কোন ভূমিকা থাকতে পারে, এমন কথা আমাদের কর্তাব্যক্তিরা কখনো তাদের চিন্তায় এনেছেন বলেও মনে হয় না।
উৎপাদক, বিপনণকারী, মধ্যস্বত্ত্বভোগী-এরা ছাড়াও কিন্তু কোরবানির পশুর ব্যবসায় একটি শ্রেণি জড়িত। তারা হচ্ছে ক্রেতা বা ভোক্তা। এই ক্রেতদের অবস্থা কিন্তু বিচিত্র। একথা সত্য, দেশে এখন একটা শ্রেণিকে দেখতে পাওয়া যায়, যারা অস্বাভাবিক রকম দ্রুতগতিতে বিপুল অর্থ উপার্জন করতে পেরেছে। এই উপার্জনের পদ্ধতি ভালো কী মন্দ-সেটা এক দীর্ঘ আলোচনা। সে আলোচনায় না গিয়েও এতটুকু বলা যায়, কিছু মানুষের হাতে আসলেই অপরিমিত নগদ অর্থ চলে এসেছে। এদের জন্য কোরবানির বিশাল বিশাল গরু কেনা অনেকটা উৎসবের মতো। তারা অনেক টাকা খরচ করে গরু কেনে। তাদের কাছে গরুর ওজন বা মাংশের পরিমাণটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারা দেখে দামটা কত বেশি হলো। দাম বেশি হলে-প্রদর্শনের সুযোগ বেড়ে যায়। পাড়ায় ভাবমূর্তি উজ্জলতর হয়।
সমস্যায় থাকে আসলে মধ্যবিত্তরা। বিশেষ করে ধর্মভীরু মধ্যবিত্তরা। ধর্মীয় কারণে তারা কোরবানি দিতে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে হিমশিম খায়। ধর্মীয় বিবেচনায় একটা গরু সাতজনে মিলে কোরবানি দেওয়া যায়। মোটামুটি মাঝারি সাইজের গরুর দামও এবার সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা হয়ে যায়। সে হিসাবে সাত জনের প্রত্যেককে বাজেটে বাড়তি ২০ হাজার টাকার সংস্থান রাখতে হয়। এটা আসলেই অনেকের জন্য কঠিন। ফলে তাদের পক্ষে অনেক সময়ই কোরবানিটা ধনাঢ্যদের মতো আনন্দদায়ক হয় না। আসলে পশুর আকাশচুম্বি দামের কারণেই ঈদ উল আযহার আনন্দটা সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে আর সমানভাবে ছড়িয়ে
পড়তে পারে না। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে অনেক সময় রীতিমত দুঃশ্চিন্তার উপলক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হয় এই কোরবানি।
একটা সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত বা মিয়ানমার থেকে প্রচুর গরু আসতো আামদের এখানে। সে কারণে তখন গরুর দাম অনেকটা কম থাকত। গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ভারতে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে, ভারত থেকে গরু আসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে মিয়ানমার থেকেও আসছে না। বিদেশী গরু না আসা নিয়ে আমরা খুব একটা দুঃখিত নই। কারণ সেটা আমাদের খামার ব্যবসায়ের জন্য ক্ষতিকর ছিল। তাই বিদেশ থেকে গরু আসা যখন বন্ধ হয়ে গেল, আমরা বরং খুশিই হলাম, ভাবলাম—এবার তাহলে কৃষকরা কিছুটা লাভবান হতে পারবে। তবে একটা শঙ্কা ছিল গরুর সরবরাহ নিয়ে। চিন্তা ছিল-আমাদের খামারিরা পারবে তো দেশের চাহিদা অনুযায়ী গরু উৎপাদন করতে? সে সন্দেহটা শেষ পর্যন্ত অমূলক বলেই প্রমাণ হয়েছে। গত কয়েক বছরের হিসাবে দেখা যাচ্ছে-চাহিদার তুলনায় অনেক বেশিই আমাদের গরুর সরবরাহ। তাহলে গরুর দাম কমছে না কেন? আবার উৎপাদক খামারিরাই বা কেন হতাশায় ভুগছে? কেন তারা মুনাফা ঘরে তুলতে পারছে না। ফাঁকটা কোথায়? সবই কি তাহলে চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে?