1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ওয়াসার ‘সুপেয়' পানির শরবত মুখে তোলেননি কেউ

২৩ এপ্রিল ২০১৯

ঢাকার জুরাইনবাসীর ওয়াসার ‘সুপেয় পানির' শরবত খাননি ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খান৷ খাবেন কিভাবে, তিনি অফিসইে ছিলেন না! আর যাঁরা অফিসে ছিলেন, তাঁরাও খাননি৷ তবে ওয়াসার এমডি'র মতো তাঁদেরও দাবি, ‘ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ এবং সুপেয়'৷

https://p.dw.com/p/3HHtU
Bangladesch l Protestaktion "Safe water"
ছবি: bdnews24.com

গত ১৭ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র পক্ষ থেকে ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে৷ এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সিদ্ধ করে পান করে৷ গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়৷''

এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় শনিবার এক সংবাদ সম্মেলন করে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়, বিশুদ্ধ৷ একে ফুটিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন হয় না৷''

শরবত নিয়ে ওয়াসা ভবনে

এই পরিস্থিতিতে ঢাকার জুরাইনবাসী মঙ্গলবার দুপুরের আগে কারওয়ান বাজার ওয়াসা ভবনে গিয়েছিলেন ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খানকে ওয়াসার পানির শরবত খাওয়াতে৷ তাঁরা জগে করে ওয়াসার পনি, লেবু, চিনি নিয়ে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু তার আগেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়৷ তাঁরা বাইরে দাঁড়িয়ে তারপরও অপেক্ষা করছিলেন, যদি এমডিকে এক গ্লাস ওয়সার সুপেয় পানির শরবত খাওয়ানো যায়৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেল এমডি অফিসে নেই৷ তাঁদের ভিতরে ঢুকতেও দেয়া হলো৷ কিন্তু কর্মকর্তা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউই সেই সুপেয় শরবত খাননি৷

পানিতে দুর্গন্ধ, মুখে দেয়া যায়না: এলাকার বাসিন্দা

ওয়াসার এমডিকে এই শরবত খাওয়ানোর চেষ্টায় নেতৃত্ব দেন জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৫৩ নাম্বার ওয়ার্ডের বাসিন্দরা৷ মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার ওয়াসার পানি ড্রেনের পানির মতো অপরিষ্কার৷ এটা তো খাওয়া দূরের কথা, গন্ধে হাতেই নেওয়া যায় না৷ এ অবস্থায় ওয়াসার এমডি কীভাবে বলেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়, বিশুদ্ধ৷ তাই আমরা এই পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে তাঁকে খাওয়াতে এসেছি৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘২০১২ সালে আমরা জুরাইনের সাড়ে ৩ হাজার বাসিন্দা গণস্বাক্ষর নিয়ে ওয়াসার এমডি'র কাছে অভিযোগ করেছিলাম৷ কিন্তু কোনো কাজ হয়নি৷ এখনো প্রতিদিন ময়লা পানি আসে৷ আমরা কয়েক বছর ধরে ওয়াসার পানি শুধুমাত্র গোসল, কাপড় ও বাসনকোসন ধোয়ার জন্য ব্যবহার করছি৷ খাওয়ার জন্য মসজিদের টিউবওয়েলের পানি কিনে খাচ্ছি৷ প্রতি ১০ লিটার পানির জন্য ২ টাকা দিতে হয়৷''

পরিচালকও শরবত খেলেন না

ওয়াসার এমডি অফিসে না থাকায় দুপুরের পর জুরাইনবাসীকে ওয়াসা ভবনে ঢুকতে দেয়া হয়৷ সেখানেও মিজানুর রহমান জুরাইন থেকে আনা ওয়াসার পানি এবং শরবতের উপকরণ নিয়ে যান৷ তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাঁর অভিযোগ আমরা লিখিত আকারে নিয়ে আমাদের টিম পাঠিয়েছি তাঁর পানির লাইন এবং পানি দেখতে৷ তাঁরা বলছেন, আগে পানি ঠিক ছিল৷ এখন খারাপ হচ্ছে৷ কেন খারাপ হচ্ছে, আমরা তা দেখব৷'' তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘তিনি আমাকেও শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু আমি খাইনি৷ কারণ, আমি তো নিশ্চিত নই যে, তিনি ওই পানি কোথা থেকে এনেছেন৷ তাঁর পানি আমরা দেখব, পরীক্ষা করব৷ আমি তাঁর বাসায় গিয়ে শরবত খেয়ে আসব বলে কথা দিয়েছি৷''

তিনি জানান, ‘‘এমডি সাহেব সকাল থেকে বাইরে নানা মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি ওয়াসা ভবনে ছিলেন না৷ ফলে জুরাইন থেকে আসা গ্রাহকদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি৷''

ওয়াসার পাইপ লাইনগুলো ত্রটিপূর্ণ ফলে নানাভাবে দুষিত পদার্থ পানিতে মিশে যায়: ড. ইফতেখারুজ্জামান

পাইপের পানিতে ই-কোলাই

গত অক্টেবরে বিশ্বব্যাংকের এক  প্রতিবেদনের আরো বলা হয়েছে, পাইপ লাইনের পানির ৮২ শতাংশেই রয়েছে ই- কোলাই ব্যাকটেরিয়া৷ ৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতে পাওয়া গেছে এই ক্ষতিকর ব্যাকটরেয়িা৷ পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটরেয়িাকে দায়ী করা হয়৷

এর আগে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের পর ওয়াসার পানিতে ই-কোলাই ব্যাকটরেয়িা আছে কিনা, তা পরীক্ষার জন্য চার সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে দুই মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল৷ তা দাখিল না করায়  আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে৷ এ বিষয়ে শুনানির  জন্য আগামী ৫ মে পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ৷

টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওয়াসার পানি কেন দূষিত হয় তা ওয়াসাই বলতে পারবে৷ আমরা দেখেছি যে, সাধারণ মানুষ অভিযোগ করছে এই পানি ময়লা এবং দুর্গন্ধযুক্ত৷ এই পানি খেয়ে সাধারণত নানা ধরনের রোগে আ্ক্রান্ত হন তাঁরা৷ ওয়াসার বেশির ভাগ পানিই গভীর নলকুপ দিয়ে ভূগর্ভ থেকে তোলা হয়৷ এর একটি অংশ নদী থেকে নেয়া হয়৷ বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় সমস্যা থাকলে পানি দূষিত হতে পারে৷ বিশেষ করে ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক থাকতে পারে৷''

তবে তিনি বলেন, ‘‘প্রধান সমস্যা সরবরাহ সিস্টেমে৷ ওয়াসার পাইপ লাইনগুলো ত্রুটিপূর্ণ৷ ফলে নানাভাবে দুষিত পদার্থ পানিতে মিশে যায়৷ এটা দেখার দায়িত্ব ওয়াসার, কিন্তু তা তারা দেখে না৷''

পানি কোরোসিনের মতো

ঢাকা শহরে যত ময়লা আবর্জনা ও দূষিত পদার্থ সবই এই পাইপলাইনে ঢোকে: ইমামুল হক

রাজধানীর  ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দাও একই অভিযোগ করেন৷ তাঁরা বলেন, ‘‘ওয়াসার পানি না ফুটিয়ে পান করা অসম্ভব৷ আর কখনো কখনো এই পানি কোনোভাকেই পান করা যায় না৷ পানিতে দুর্গন্ধ থাকে৷ মুখে দেয়া যায় না৷ কেরোসিন তেলের মতো রঙ হয়৷ আবার এই পানি ব্যবহার করলে শরীর চুলকায়৷ ব্যবহারের অযোগ্য পানি৷''

তাঁরা আরো অভিযোগ করেন, ‘‘এই পানির কারণেই নানা ধরনের পেটের পীড়া হয়৷ পানি খেলে বমি বমি ভাব হয়৷ বাচ্চারা খেতেই পারে না৷ আর খাবার পানি কিনে খেতে হয়৷ অভিযোগ জানিয়ে কোনো কাজ হয় না৷'' 

তাঁদের মতে, ‘‘ওয়াসার এমডি এই পানিকে বিশুদ্ধ এবং সুপেয় বলে আসলে মিথ্যাচার করেছেন৷ তিনি তাঁর চাকরি রক্ষায় এসব কথা বলছেন৷ ওয়াসার পানি যদি সুপেয় হতো, তাহলে আজ তো তার সেই পানির শরবত পান করার কথা ছিল৷ তিনি তা করলেন না কেন?''

এদিকে পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইমামুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে ২০ থেকে ২৫ ভাগ পানি আসে ভূপৃষ্ঠ থেকে৷ বাকি পানি ভূগর্ভস্থ পানি৷ তাই পরিশোধন পর্যায়ে পানি ঠিকই থাকে৷ উৎসে পানির মান বজায় থাকে৷ কিন্তু সমস্যা হয় সরবরাহ লাইনে৷ এই লাইনগুলো খুবই খারাপ৷ ঢাকা শহরে যত ময়লা আবর্জনা ও দূষিত পদার্থ আছে, তার সব এই পাইপলাইনে ঢোকে৷ কিন্তু ওয়াসার দায়িত্ব হলো গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দেয়া, সেটা তারা করেন না৷ তাই পানিতে শুধু ই-কোলাই কেন, আরো অনেক জীবাণু এবং দূষিত পদার্থ থাকে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘ওয়াসা এটাকে গুরুত্বই দেয় না৷ এদেশে প্রধানমন্ত্রী না বললে তো কিছু হয় না৷ হয়তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷''

উৎসে ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ আমরা হু-এর মান অনুযায়ী পানি বিশুদ্ধ করি: একেএম সহিদ উদ্দিন

ওয়াসা আগের অবস্থানেই 

আর  ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘উৎসে ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ৷ আমরা হু-এর মান অনুযায়ী পানি বিশুদ্ধ করি৷ এখন কেউ যদি চোরাই লাইন নেন, কারুর পানি রিজার্ভারে যদি  সমস্যা থাকে, দূষিত পদার্থ থাকে, যদি নিয়মিত পরিস্কার না করে, সে দায়িত্ব কে নেবে?'' তাঁর কথা, ‘‘আমাদের লাইন ঠিক আছে৷ দু-এক জায়গায় সমস্যা থাকতে পারে৷ কিন্তু  অবৈধ লাইন দিয়ে লাইন খারাপ করা হয়৷''

কথা বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেও ওয়াসার এমডিকে পাওয়া যায়নি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য