ওডি কোলন কারখানার তিন শো বছর পূর্ণ
২৪ জুলাই ২০০৯এই সুগন্ধির প্রস্তুত প্রণালী সেই তখন থেকে আজ পর্যন্তও রয়েছে অপরিবর্তিত সেই সাথে অত্যন্ত গোপনীয়৷
ইটালিয়ান বংশোদ্ভূত ফারিনা বেশ কয়েক বছর ধরে কোলন শহরে বসবাস করছিলেন তখন৷ অ্যালকোহলের সঙ্গে লেবু জাতীয় নানা রকম ফলের নির্যাস মিলিয়ে একদিন এক সুগন্ধি তৈরি করেন তিনি৷ উচ্ছ্বসিত হয়ে ভাইকে চিঠি লেখেন ফারিনা, ‘‘আমি এমন এক সুগন্ধি খুঁজে পেয়েছি, যা ইটালির বসন্তের সকালকে মনে করিয়ে দেয়৷ বৃষ্টির পর ভেসে আসা পাহাড়ের ডেফোডিল ফুল, কমলার মুকুলের সুগন্ধ স্মরণ করিয়ে দেয়৷''
ফারিনা তাঁর প্রিয় শহর কোলনের নামে এই সুগন্ধির নাম দেন ও ডি কোলন৷ তারপর থেকে কেটে গেছে ৩০০ বছর৷ কিন্তু ও ডি কোলনের গন্ধে বা প্রস্তুত প্রনালীতে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ আর এর প্রস্তুত প্রণালী এতই গোপন করে রাখা হয়েছে যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ জন জানেন, কিভাবে তৈরি করতে হয় এই পারফিউম৷ এর মধ্যে একজন এখনকার ও ডি কোলন কারখানার উত্তরাধিকারী ও ম্যানেজার জোহান মারিয়া ফারিনা৷ তিনি বলেন, ‘‘আসল কথা মূল ওডি কোলনের সুরভি সব সময় একরকম থাকতে হবে৷ অনেকটা শ্যাম্পেইনের মত৷ নানা কৃষিক্ষেতের আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত ওয়াইন মিশিয়ে যেমন বিশেষ স্বাদ ও গন্ধের শ্যাম্পেইন প্রস্তুত করা হয়৷ তেমনটি করা হয় আমাদের সুগন্ধির ক্ষেত্রেও৷ কোনো ফল থেকে পাওয়া সুগন্ধি একটু ভিন্ন রকম হলে বিভিন্ন ক্ষেতের ফসলের নির্যাস মিশিয়ে ভারসাম্য আনা হয়৷''
ফারিনার ওডি কোলনের জয়যাত্রা শুরু হয় প্রথম থেকেই৷ লেবু, কমলা, বাতাবিলেবু এসব ফলের নির্যাস থেকে প্রস্তুত হালকা, ঝরঝরে সুরভি আকৃষ্ট করে মানুষকে৷ তবে সে সময় তা ছিল বিলাস দ্রব্য৷ কেবল রাজা রাজড়া ও অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিরাই সবুজ, হালকা পাতলা শিশিতে ভরা এই পারফিউম কেনার ক্ষমতা রাখতেন৷ একজন চাকুরীজীবীর ৬ মাসের বেতনের সমান ছিল ওডি কোলনের এক শিশির দাম৷
শোনা যায় জার্মান সম্রাট ফ্রিডরিশ ডেয়ার গ্রোসে, রাশিয়ার জার, বিশ্বখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক গোয়েটে, ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়ান বোনাপার্ট পছন্দ করতেন ওডি কোলন, ব্যবহার করতেন সবসময়৷ ১৭৪৭ সাল নাগাদ সারা ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়ে ওডিকোলোনের নাম৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায় কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মনমাতানো এই সুরভি৷
তবে ওডি কোলনের জয়যাত্রা শুধু যে কুসুমাস্তীর্ণ ছিল তা নয়, নানা রকম বাধা বিঘ্নও অতিক্রম করতে হয়েছে এই পারফিউমকে৷ এ প্রসঙ্গে জোহান মারিয়া ফারিনা বলেন, ‘‘অনেক সংকট ছিল৷ ফরাসি বিপ্লব, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টা ছিল সবচেয়ে বেশি সংকটময়৷ আমাদের পক্ষে কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় উৎপাদন দারুণ ব্যাহত হয়েছিল৷ জিনিস প্রস্তুত করতে পারলে ভবিষ্যতের আশাও আমরা করতে পারি৷ ইদানিং অর্থনৈতিক মন্দার কথা সবাই বলছেন৷ আমাদের কাছে কিন্তু তা এসে পৌঁছায়নি এখন পর্যন্ত৷''
ওডি কোলনের এই সাফল্যে অনুকরণপ্রবণতাও দেখা দিয়েছিল৷ ওডি কোলন আবিষ্কারের ১০০ বছর পর কোলনের আর এক ব্যবসায়ী ভিলহেল্ম ম্যুলেন্স লেবু জাতীয় ফল দিয়েই আর এক ধরণের সুগন্ধি তৈরি করেন এবং নিজের বাসার নম্বর অনুযায়ী নাম দেন ৪৭১১৷ এই পারফিউম বিশ্ববিখ্যাত হলেও আসল নয়৷ সে সময় এ বিষয়টি নিয়ে অনেক ঝগড়া বিবাদ হলেও আজ সেটা আর কোনো সমস্যা নয়৷
এ প্রসঙ্গে ফারিনা বলেন, ‘‘ওই পরিবারের ফের্ডিনান্ড ম্যুলেন্স-এর এক মেয়ের সঙ্গে আমি নাচ শিখতেও গিয়েছিলাম৷ আগের সেই ঘটনা দুই পরিবারের মধ্যে কোনো সমস্যাই নয়৷''
কোলনের পুরানো শহরে তিনশো বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় ওডি কোলন কোম্পানির কেন্দ্র ৷ আজও সেখানে আসল ওডি কোলন কেনা যায়৷ বাড়ির ভেতরে নিজস্ব মিউজিয়ামে দেখা যায় সেই আমলের বিভিন্ন সামগ্রী৷ ওডি কোলন সম্পর্কে অনেক কিছু জানাও যায়৷ শোনা যায় দর্শকদের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ৷
‘‘আমি কখনও পারফিউম মিউজিয়াম দেখিনি৷ এটা খুবই আকর্ষণীয়৷ আর পারফিউমের সুগন্ধও খুব তরতাজা৷''
প্রতিবেদক: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আবদুস সাত্তার