এবার মাঠে নামছেন সম্পাদকরা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮২৯ সেপ্টেম্বর দেয়া হয়েছে মানববন্ধনের কর্মসূচি, পরবর্তীতে আসতে পারে আরো বড় ধরনের আন্দোলনের ডাক৷ এনিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যেও৷
শনিবার সম্পাদক পরিষদের কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি সম্পাদক পরিষদের মহাসচিব মাহফুজ আনাম, টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সহ-সভাপতি মোজাম্মেল হক বাবু এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন৷
তাঁরা বিবৃতিতে বলেন, ‘‘জাতীয় সংসদে বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলটি ১৭ সেপ্টেম্বর একতরফাভাবে উত্থাপন করেছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটিবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি৷ এতে যথাযথভাবে সাংবাদিক সম্প্রদায়ের সুপারিশ প্রতিফলিত হয়নি৷ জাতীয় সংসদের স্থায়ী কমিটি সংসদে বিলটি উত্থাপনের আগে স্বার্থ-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার প্রতিশ্রতি দিলেও তা রক্ষা করা হয়নি৷ সরকার বিতর্কিত এই বিলটি একতরফাভাবে গ্রহণ করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন৷''
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘কিছু পরামর্শ গ্রহণ করা হলেও আইনের কয়েকটি ধারা সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিপক্ষে গেছে৷ সংবাদমাধ্যমে কর্মরত ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি আইনে৷ বরং ‘তথ্য অধিকার আইন' ও ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি আইনের' অস্তিত্বেপ কারণে একটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি করা হয়েছে৷ পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো ও গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়ার মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে৷''
অতীতে এমন আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে উল্লেখ করে সরকারকে আইন সংশোধনে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বিবৃতিতে৷ বলা হয়েছে, ‘‘আমরা মনে করি আইনটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সামঞ্জস্য বিধানের সুযোগ এখনো আছে৷''
এদিকে, শনিবারই সম্পাদক পরিষদ বৈঠক করে এই আইনের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করে৷ ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হবে৷ সম্পাদকরা সব সাংবাদিকদের এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংবাদপত্র বলতে আমরা বুঝি মুক্ত গণমাধ্যম৷ সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে, সাংবিধানিক স্বাধীনতা থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বহু মতের প্রকাশ থাকবে৷ ৫৭ ধারার আমরা অবলোপ চেয়েছি৷ এরপর যখন ডিজিটাল আইন সামনে এলো তখনই আমরা সাংবাদিকরা বেশ কয়েকটি ধারা উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছি৷ সাংবাদিক সমাজ, সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতা এবং সম্পাদকরা একাধিকবার বিবৃতি দিয়েছেন, এবং কোথায় কোথায় স্বাধীন সংবাদপত্রের ব্যত্যয় ঘটবে কিংবা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা যাবে না সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারই ধারাবাহিকতায় আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটিসহ সরকারের অন্য আরো অনেক পর্যায়ে বসেছেন সম্পাদক -সাংবাদিক নেতারা, মত বিনিময় করেছেন৷ তারা নিজেরাও উপলব্ধি করেছেন, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২- এই ধারাগুলো স্বাধীন সংবাদপত্রের জন্য অনুকুল নয়৷ সাংবাদিকতার ওপর একটি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেয়ার যথেষ্ঠ সুযোগ এই ধারাগুলোতে রয়েছে৷ আমরা এই ধারাগুলোর প্রতিবাদ করেছি৷ আমাদের বলা হয়েছে বিবেচনা করা হবে৷ যখন আইনের পর্যায়ে আসবে তখন এগুলো থাকবেনা৷ কিন্তু আমরা দু:খজনকভাবে দেখলাম, যখন আইনটি সংসদে পাশ হলো. এর অনেকগুলো ধারাই রয়ে গেছে৷ এর মধ্যে অনেকগুলো ধারা অজামিনযোগ্য৷ কিছু ধারায় শাস্তি কমানো হয়েছে৷ কিন্তু তল্লাশির নামে পুলিশের যে বিশেষ ক্ষমতা সেটি আবার প্রদান করা হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এরকম একটি পরিস্থিতিতে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে মানববন্ধন ছাড়া আর কোনো কর্মসূচির কথা ভাবতে পারিনি৷''
তিরি আরো বলেন, ‘‘সরকার বলছে, যারা সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করবে তাদের এই আইন নিয়ে ভয়ের কোনো কারণ নেই৷ কিন্তু সৎ, বস্তুনিষ্ঠ, ভয়ের কোনো কারণ নেই, এগুলো আপেক্ষিক কথা৷ এগুলো কখন কিভাবে কার ওপর প্রয়োগ হবে তা বলা কঠিন৷''
যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আরো বলেন, ‘‘আমরা জানি বিশেষ ক্ষমতা আইন আওয়ামী লীগের আমালে করা হয়েছিল৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল না তখন তাঁদের ওপর তা বিশেষভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে৷ যাঁরা আইনটি করেছেন তাঁরা যখন ক্ষমতার বাইরে গেছেন তখন তাঁদের ওপরই এ আইন বেশি মাত্রায় প্রয়োগ হয়েছে৷ কাজেই আইনটি কিভাবে প্রয়োগ হবে, কতটা অপপ্রয়োগ হবে এটাতো আর কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনা৷ কেউ তো গ্যারান্টি দিতে পারেনা৷ এমন কোনো গ্যারান্টি ক্লজ যদি থাকতো যে এই আইনটি অপব্যহার হবেনা, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবেনা, এভাবেতো আইন করা যায়না৷ তাই আমি মনে করি এই আইনটি স্বাধীন সাংবাদিকতার অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে৷''
সম্পাদকদের এই কর্মসূচিতে মাঠের সাংবাদিকরা উৎসাহ দেখাচ্ছেন৷ তাঁরা মনে করেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সম্পাদকদের মাঠে নামার এই কর্মসূচি ভালো ফল বয়ে আনবে৷
ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার জামিউল আহসান সিপু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগে সাংবাদিকদের আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পাদকরা মাঠে থাকতেন না৷ আমরা মাঠের সাংবাদিকরাই থাকতাম৷ এবার সম্পাদকরাই মাঠে নামছেন, মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়েছেন৷ এটা ভালো একটা দিক৷ আন্দোলন কর্মসূচিতে সম্পাদকরা যেহেতু একতাবদ্ধ হয়েছেন, এটা অবশ্যই নতুন একটি ডায়মেনশন সৃষ্টি করবে৷ সংসদে পাশ হওয়া ডিজিটাল আইনের প্রতিবাদে সম্পাদকরা যে কর্মসূচি দিয়েছেন, আমি মনে করি এটা সফল হবে এবং ফল বয়ে আনবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সকল সাংবাদিকের উচিত হবে এই কর্মসূচিতে যোগ দেয়া৷ আমি নিজেও যোগ দেব৷''
তবে একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন মনে করেন, সম্পাদকদের আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া উচিত ছিল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সম্পাদকরা ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী৷ বাংলাদেশে এখন যারা দুর্বল বা শক্তিহীন তারাই মানববন্ধনের মত কর্মসূচি দেন৷ সম্পাদকদের ক্ষমতার যে পরিধি তার সঙ্গে এই মানববন্ধন কর্মসূচি কতটা শক্তিশালী কর্মসূচি তা নিয়ে আমি সন্দিহান৷ তবে তাঁরা প্রথমবারের মত মাঠের কর্মসূচি দিয়েছেন সেটা অবশ্যই আশার কথা৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা যারা মাঠের সাংবাদিক তারাই প্রথম কোনো আইন বা ঘটনার শিকার হই৷ সেই প্রেক্ষাপট থেকে একজন মাঠের সাংবাদিক হিসেবে সম্পাদকদের এই কর্মসূচিতে অবশ্যই যোগ দেব৷ আমরা দেখতে যাব তাঁরা আরো কোনো কঠোর কর্মসূচি দেন কিনা৷ তারা আসলেই শক্তিশালী কোনো প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করেন কিনা৷ যে প্রেসার গ্রুপ হিসেবে আসলে তাঁদের কাজ করারই কথা৷''
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সম্পাদক মালিকরা মনে করেছেন তাঁরা এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ তাই তাঁরা মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েছেন৷ আমাদের ইউনিয়নকে তাঁরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানাননি৷ আহ্বান জানালে আমরা ইউনিয়নে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সম্পাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মনে করেন বলেই কর্মসূচি দিয়েছেন৷ আমরাও দেখছি৷ আমাদের সাংবাদিকরা যদি এই আইনের শিকার হন, সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে আমরা মাঠে নামবো৷ রুখে দাঁড়াবো৷''
পাকিস্তান আমলে সম্পাদকদের এরকম ঐক্যবন্ধ কর্মসূচি দেখা গেছে৷ বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের পতনের আগে সম্পাদকরা সম্মিলিতভাবে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিলেন৷ এর বাইরে সম্পাদকদের কোনো কর্মসূচিতে মাঠে নামতে দেখা যায়নি বলে সাংবাদিকরা জানান৷ তরুণ সাংবাদিকদের অনেকেই এই প্রথম সম্পাদকদের মাঠের কর্মসূচি দিতে দেখলেন৷
তবে সাইফুল আলম বলেন, ‘‘এই প্রথম না, আমরা পকিস্তান আমলেও লক্ষ্য করেছি এরকম একটি পরিস্থিতিতে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সম্পাদকরা অবস্থান নিয়েছেন৷ তখন সম্পাদকরা সম্মিলিতভাবে ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাড়াও' এই শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখেছেন৷ স্বাধীন বাংলাদেশেও সম্পাদকরা দু-একবার রাজপথে নেমেছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন৷ সম্পাদকদের জাতীয় প্রেসক্লাবে সেই প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম৷ যদিও তখন আমি সম্পাদক ছিলাম না৷ যখনই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রশ্ন এসেছে, মুক্ত গণমাধ্যমের প্রশ্ন এসেছে, তখনই কিন্তু সাংবাদিকরা, সম্পাদকরা স্বাধীন সংবাদপত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন৷''