‘এবার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সীমিত হবে’
১০ ডিসেম্বর ২০১৮ডয়চে ভেলে: সামনেই আরেকটি সংসদ নির্বাচন৷ এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আপনাদের প্রস্তুতি কেমন?
শারমিন মুরশিদ: আমাদের সব সময়ই প্রস্তুতি থাকে৷ তবে এবার একটু জটিলতা আছে৷ এবার নির্বাচন কমিশন আমাদের অনুমতি দেয়নি৷ ফেমা আর ব্রতী-কে তারা অনুমোদন দেয়া হয়নি৷ যা-ই হোক, ‘একটা টেকনিক্যাল ডিফিকাল্টি'-র কথা বলে তারা এর ব্যাখ্যা দিয়েছে৷ যেহেতু পর্যবেক্ষণ একটি নাগরিক দায়িত্ব, এ কারণে আমরা মনে করি যে, সকল নাগরিকের নিজ এলাকায় সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিত৷ যে নির্বাচনটি হচ্ছে, সেটা নিয়ে আমাদের একটা অবস্থান হলো – সবাই যার যার জায়গায় এটা পর্যবেক্ষণ করবে৷ আমরা আমাদের কাজটি আমাদের মতো করে করে যাবো৷ আমাদের কাজটি মূলত গবেষণাধর্মী৷
এবারের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক কি আগের চেয়ে বাড়ছে, না কমছে?
আপাতদৃষ্টিতে আমরা যা দেখছি-জানছি তাতে মনে হচ্ছে কমছে৷ দেখুন, এবার আমরা তো আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে কোনো প্রতিশ্রুতি পাইনি৷ জাতীয় পর্যায়ের কিছু সংগঠন আছে, তাদের মধ্যেও একটা চিন্তা-ভাবনা চলছে৷ কতটুকু করবে, কীভাবে করবে, কেমনভাবে করবে? তবে আগের তুলনায়, বিশেষ করে ২০০৮ সালে যে বিপুল পর্যবেক্ষকের অংশগ্রহণ ছিল, সেটা এবার হবে না৷ তবে এবার নতুন কিছু জোট আমরা দেখছি, তারা বড় আয়োজন করে নামছে৷ কিন্তু তারা একেবারে নতুন৷ ফলে তাদের প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে আছে সেটা এখনই বলা মুশকিল৷
ইউরোপীয় ইউনিয়ন কেন পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না?
আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন যে, ওদের অগ্রাধিকারের জায়গা ভিন্ন৷ আরেকটি বিষয় হলো যে, ২০১৪ সালে কোনো আন্তর্জাতিক মহল পর্যবেক্ষণ করেনি৷ কারণ, সেটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছিল না৷ এবার কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এজেন্সি বলেছে যে, তাদের গুরুত্ব রোহিঙ্গা ইস্যুসহ অন্যান্য জায়গায়৷ এ কারণে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তারা খুব একটা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না৷ তবে তারা বলেছে যে, তাদের বিশেষজ্ঞ দল উপস্থিত থাকবে, তবে ছোট আকারে৷ তাদের সর্বশেষ অবস্থান কী হবে, সেটা জানতে পারবো দু-চারদিনের মধ্যেই৷ তাদের সাথে আমাদের মিটিং আছে৷ আমরা আমাদের কথা বলব, ওদের দিক থেকেও ওদের জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করব, শোনার চেষ্টা করব৷ আমি জানার চেষ্টা করব তাদের কেন অনীহা? আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক মহল থেকে একটা পর্যবেক্ষণ হওয়া উচিত৷
এবার বিদেশি পর্যবেক্ষক কমছে ,না বাড়ছে?
এখনো আমরা কোনো ‘কমিটমেন্ট' পাইনি৷ তাই এই মুহূর্তে বলা মুশকিল৷ এখন পর্যন্ত কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলেনি যে, তারা আসছে কিনা৷ বিশেষ করে যারা এই কাজগুলো করে থাকে, তারা কেউই স্পষ্টভাবে কোনো ঘোষণা দেয়নি৷ সেই জায়গা থেকে আমরা অপেক্ষা করতে পারি৷ আমার মনে হয়, কয়েকদিন পরে সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে৷
বিদেশি পর্যবেক্ষক না এলে কি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে?
সেটা আমি বলবো না৷ এই মুহূর্তে সেটা বলা ঠিকও হবে না৷ ভোটারদের মধ্যে অসন্তোষ থাকতেই পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও অসন্তোষ থাকতে পারে৷ তবে নির্বাচন যদি সংঘাতময় হয়, তখন কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়৷ সংঘাতের মধ্যে যে নির্বাচন হয়, সেটা সুষ্ঠু হয় না৷ আমরা পর্যবেক্ষক হিসেবে একটা মৌলিক অবস্থান নিয়ে থাকি৷ দেখার বিষয় হচ্ছে, কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা৷ দেশীয় যে পর্যবেক্ষকরা পর্যবেক্ষণ করবেন, তারা কতটুকু করতে পারবেন সেটাও কয়েকদিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ তবে মিডিয়ার উপস্থিতি তো থাকবেই৷ আমাদের দেশের মিডিয়া কিন্তু এক ধরনের পারদর্শীতা এর মধ্যে অর্জন করেছে৷ সেখানে কিন্তু বিশালভাবে অনিয়ম হলে বা সে ধরনের কোনো পরিস্থিতি হলে তখন এগুলো আর আড়াল থাকবে না৷ এগুলো সামনে কোনো না কোনোভাবে চলে আসে৷ আপনি যেটা বলছিলেন যে, সুষ্ঠু ‘অবজারভেশন' একদম হবে না, সেটা বলছি না৷ তবে বলছি, এবার এর আকার সীমিত হবে৷
বাংলাদেশে কতগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা আছে, যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে?
এই মুহূর্তে আমি বলতে পারব না৷ কিন্তু একটা তথ্য বলতে পারি৷ ১১৮ থেকে ১২০টির মতো সংস্থা নির্বাচন কমিশনের তালিকাভুক্ত হয়েছে৷ সেই তালিকার ভিতর আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি যে, গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো সংস্থা বাদ পড়েছে৷ বেশ কিছু নাম আমরা দেখতে পাচ্ছি, যাদের সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি৷
আপনারা মাঠ পর্যায়ে যাদের কাজে লাগান, তাদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন?
শুনুন, আমাদের একটা ‘মেথডোলজি' আছে৷ আমরা দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ করি, দিনব্যাপী করি, পূর্বেরটা দেখি, আবার পরেরটাও দেখি৷ ‘সিডিউল' ঘোষণার পরে আমারা প্রতিদিন একটা ‘ফলো আপ' করে থাকি৷ সেটা মাঠ পর্যায়ে না, কেন্দ্রীয়ভাবে৷ এটা আসলে খুব ব্যয়বহুল একটা কাজ৷ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আমরা ভোটের দিনই মূলত করে থাকি৷ পাশাপাশি ভোটের আগের তিন দিন এবং পরের তিন দিনও আমরা করে থাকি৷ এখানে আমরা একেবারেই আমাদের ‘গাইডলাইন' ধরে, আমাদের একটা ‘প্রটোকল' আছে সেটা ধরে ধরে আমরা পর্যবেক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেই৷
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যয় কীভাবে আপনারা নির্বাহ করেন?
আমরা ‘ভলেনটিয়ার অর্গানাইজেশন' হিসেবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পেয়ে থাকি৷ আবার স্বতন্ত্রভাবে বহু সংস্থা এই কাজটা করছে৷ যেমন ধরুন, বিদেশি অর্থ না থাকলেও আমরা এটা করি৷ সেই ধরনের একটা কাঠামো ইতিমধ্যে আমাদের দেশে দাঁড়িয়ে গেছে৷
বাংলাদেশে পর্যবেক্ষকদের মতামতকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হয়?
এটা একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন৷ আমার মনে হয়েছে, এই চর্চাটা যত পোক্ত হয়েছে, তত জনপ্রিয় হয়েছে৷ প্রাথমিক পর্যায়ে কিন্তু এতটা ছিল না৷ এখন কিন্তু গুরুত্বের জায়গায় পৌঁছেছে৷ একটা সময় নির্বাচন কমিশনও অতটা গুরুত্ব দিত না৷ আমি নিজেই ২০ বছর ধরে এই কাজ করছি৷ ২০০৮ সালে যখন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তুঙ্গে গেল, তখন পর্যবেক্ষকরা কমিশনের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করত৷ নির্বাচন কমিশন সেটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এবং কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তারা এগুলো মাথায় রাখত৷ আমরা মনে করি, নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা কিন্তু নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ৷ তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন, আমরাও নিরপেক্ষভাবে কাজ করি৷ আমরা পর্যবেক্ষণের সময় হঠাৎ কোথাও গোলযোগ দেখলে দ্রুত কমিশনকে অবহিত করতে পারি৷ তারাও সেখানে দ্রুত ‘ফোর্স' পাঠাতে পারেন৷ এমন পরিস্থিতিতে আমরা কিন্তু তাদের অনেক সহযোগিতা করেছি৷
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পর আপনাদের দেয়া সুপারিশের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়?
২০ বছর আগে আমরা যখন কাজটা শুরু করি, তখন নির্বাচন কমিশনের সাথে আমাদের সম্পর্ক মাত্র গড়ে উঠছিল৷ এটা হতে হতে একটা পর্যায়ে নিবিড়ভাবে কাজ হচ্ছিল৷ নির্বাচন কমিশনের কিন্তু সবচেয়ে ‘ন্যাচারাল অ্যালাই' হলো পর্যবেক্ষকরা৷ কারণ, নির্বাচন কমিশন একটি নিরপেক্ষ সাংবিধানিক ‘বডি' এবং সেটার কোনো দলীয় চরিত্র থাকে না৷ পর্যবেক্ষকদেরও কোনো দলীয় চরিত্র থাকে না৷ এ কারণে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল৷ নির্বাচন কমিশন সেটা মনে করেছিল এ কারণেই৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷