নতুন রাজনৈতিক সহযোগী
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৩চ্যান্সেলর থেকে গেলেন৷ কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে সরকার বদলে যাচ্ছে৷ আগামী সরকার গড়বেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ তাঁর খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী শিবির প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পেয়ে বুন্ডেসটাগ-এ সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ কিন্তু তাদের উদারপন্থি সহযোগী হারিয়ে গেছে৷ সম্ভবত খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী শিবিরই আগামী ৪ বছর দেশ শাসন করবে – হয় একা, অথবা এসপিডি-র সঙ্গে৷
চ্যান্সেলর হিসেবে ম্যার্কেল-এর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ছিল অপরাজেয়৷ তাঁর সিডিইউ দলও তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে ও গত দুই দশকে সবচেয়ে ভালো নির্বাচনি ফলাফল অর্জন করতে পেরেছে৷ শরিক দল হিসেবে এফডিপি-র ঐতিহাসিক ভরাডুবি ঘটেছে৷ ৪ বছর আগে ১৪ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকারে অংশ নিয়েছিল এই দল৷ এবার বুন্ডেসটাগ-এই প্রবেশ করতে পারলো না তারা৷ দলটির জন্য এটা একটা বিপর্যয়৷ গোটা দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রের জন্যও বিষয়টি ভেবে দেখার মতো৷ কারণ ১৯৪৯ সালে ফেডারেল জার্মানির সূচনাপর্ব থেকেই উদারপন্থিরা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে এসেছে৷
সামাজিক গণতন্ত্রীদের সঙ্গে ম্যার্কেল-এর নীতির সমন্বয় সম্ভব
সরকারি জোটের সাফল্য চ্যান্সেলরের সাফল্য হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছে৷ গোটা ইউরোপে জার্মানির বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম৷ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিও শক্তিশালী৷ দেশের ঋণভারও কম৷ এমন পরিস্থিতির জন্য জার্মানির বেশিরভাগ মানুষকেই কোনো কঠিন মূল্য চোকাতে হয় নি৷ এই পরিস্থিতি ভোটারদের মনে দাগ কেটেছে৷ তাঁরা ধারাবাহিকতা, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা চেয়েছিলেন৷ আঙ্গেলা ম্যার্কেল এ সবেরই প্রতীক৷ ৮ বছর ক্ষমতায় থেকে তিনি অভিনব এক রাজনীতিক হয়ে উঠেছেন৷ এমনকি বিরোধীদের কেন্দ্রীয় বিষয়গুলিকেও তিনি আপন করে নিয়েছেন৷ আরও সামাজিক ন্যায়, পরিবারের উপর আর্থিক ভার কমানো, বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ বন্ধ করা – এ সব বিষয়গুলি তিনি নিজেই তুলে ধরেছেন৷ লিবিয়া ও সিরিয়ায় কোনো হস্তক্ষেপ না করা, পুরোপুরি বিকল্প জ্বালানির পথে দেশকে চালনা করার পথেও তিনি দেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ গত ৪ বছরে সরকারি জোট যেন শুধু কাগজে-কলমেই সরকারি দলগুলির নীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে৷ বাস্তবে সামাজিক গণতন্ত্রী ও সবুজ দলের অনেক বিষয়ও কার্যকর করা হয়েছে৷ একেই ম্যার্কেল-এর ‘প্র্যাগমাটিস্ট' বা বাস্তববাদী মনোভাবের প্রতিফলন বলা হয় – জনগণের কাছেও যা অত্যন্ত জনপ্রিয়৷
ম্যার্কেল এবং সম্ভবত তাঁর অনুগামীদের জন্য ‘গ্র্যান্ড কোয়ালিশন' বা এসপিডি-র সঙ্গে এক মহাজোট সরকারও কোনো সমস্যা নয়৷ এমনকি এতে সুবিধাই হতে পারে৷ সরকারি জোটে এসপিডি থাকলে সংসদের উচ্চ কক্ষ ও রাজ্য সরকারগুলির প্রতিনিধিসভা ‘বুন্ডেসরাট'-এ বিরোধিতার ধার কমে যাবে৷ উল্লেখ্য, ‘বুন্ডেসরাট'-এ এই মুহূর্তে এসপিডি-র আধিপত্যের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন মুলতুবি রয়েছে৷
দলীয় রাজনীতি ব্যবস্থায় ক্ষয়
জার্মানির রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে যাচ্ছে৷ এসপিডি ও সবুজ দল তাদের নির্বাচনি ফলাফলে সন্তুষ্ট হতে পারে না৷ গত কয়েক সপ্তাহে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে পেয়ার স্টাইনব্রুক কিছুটা বাড়তি সমর্থন পেলেও এসপিডি দল মাত্র ৩ শতাংশ বাড়তি ভোট পেয়ে ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে৷ অর্থাৎ প্রত্যাশা পূরণ হয় নি৷ এসপিডি আজ জনগণের দল হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে৷ ম্যার্কেল তাদের বিষয়গুলি ছিনিয়ে নিয়েছেন, এটা যেমন ঠিক, অন্যদিকে তারা নিজেদের বিষয়গুলিকে ভোটারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে নি – এটাও ঘটনা৷ জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের প্রায় ২৫ বছর পর বামপন্থি দল ‘ডি লিংকে' দেশের তৃতীয় শক্তিশালী দল হয়ে উঠেছে৷ সাবেক পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরসূরি দলের এই সাফল্য নজর কাড়ার মতো৷ ‘আল্টারনাটিভে ফ্যুর ডয়েচলান্ড' বা জার্মানির বিকল্প নামের সদ্য গজিয়ে ওঠা দলও যথেষ্ট ভোট আদায় করতে পেরেছে৷ এই দল সব শিবিরের প্রতিবাদী, বিক্ষিপ্ত ও ক্ষুণ্ণ সমর্থকদের কাছে টানতে পেরেছে৷
সুখের দিন শেষ
ক্ষমতার সমীকরণ আমূল বদলে গেছে৷ কিন্তু এর কারণ কী? সবুজ ও উদাপন্থিদের মতো দল নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল৷ কে নেতা হবেন, বা করের হার বাড়বে কি না – এমন সব বিষয় ভোটারদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে৷ নির্বাচনি প্রচার অভিযানে তেমন কোনো আবেগ বা বিতর্কের অবকাশ ছিল না৷ দলগুলির নীতির মধ্যে তেমন পার্থক্য না থাকায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার এবারের নির্বাচনের আগে জানতেন না, তাঁরা কাকে ভোট দেবেন৷ চ্যান্সেলর ও বিরোধীরা নিজস্ব নীতিকে ভোটারদের জন্য পরিষেবা হিসেবে তুলে ধরেছেন৷ রাজনৈতিক বিতর্কের বদলে রাজনৈতিক পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখা গেছে৷ এই প্রবণতা শুধু জার্মানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়৷ তবে আজকের রাজনীতি আর অতীতের মতো এতটা রাজনৈতিক নেই৷ ২০১৩ সালের জার্মানি বেশ একটা আরামের জায়গায় বিচরণ করছে৷
ভবিষ্যতের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির জবাব চাই
ইউরোপের সংকটগ্রস্ত ও জার্মানির প্রতিবেশী দেশগুলির কাজে এবারের নির্বাচন ছিল ইউরোপের ভালমন্দের প্রশ্ন৷ অনেক প্রতিবেশী দেশের আশা ছিল, জার্মানিতে মহাজোট সরকার গঠিত হলে আর্থিক সংকট সামলানোর ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা আসবে, এতদিনের কড়া মনোভাব আর থাকবে না৷
এই নির্বাচনের মাধ্যমে জার্মানির ভবিষ্যতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ যে দেশের জনসংখ্যায় বয়স্কদের অনুপাত বেড়ে চলেছে, সে দেশে অবসর ভাতা কী ভাবে নিশ্চিত করা যাবে? বিকল্প জ্বালানির পথে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় অর্থ আসবে কোথা থেকে? সিরিয়া সংকটের ক্ষেত্রে জার্মানির অবস্থান কী হবে? সম্প্রসারিত ইউরোপ সম্পর্কে জার্মানির দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্নই বা কী হবে? বর্তমান সংকটের সমাধানের পরেও এই প্রশ্ন থেকে যায় বৈকি৷ এই প্রশ্নে জার্মানির প্রতি রাজনৈতিক প্রত্যাশা অত্যন্ত বেশি, যদিও জার্মানির রাজনৈতিক নেতৃত্ব এতকাল এই দায়িত্ব যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেছে৷ ইউরোপের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি৷ এতকাল জার্মানি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে এবং সেটা করেছে বেশ সাফল্যের সঙ্গে৷
রাজনৈতিকভাবে ‘ম্যানেজ করার' মানসিকতা বন্ধ করতে হবে
এই সব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা, আলোচনা করা, মত গঠন করা সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব৷ গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রই হলো আপোশ মীমাংসা নিয়ে বারবার আলোচনা করে একটা অবস্থানে পৌঁছানো৷ বিভিন্ন অবস্থান থেকে আলোচনা শুরু হয়৷ তারপর বিতর্কের পর একটা ফলে আসা যায়৷ আমার মতে, রাজনীতিকে আবার রাজনৈতিক হয়ে উঠতে হবে৷ জার্মানির রাজ্যপাট শুধু পরিচালনা করলে চলবে না, গঠনের কাজে মন দিতে হবে৷ নতুন সরকারের কাঁধে এই দায়িত্ব আসবে৷ আগামী কয়েক দিনে সেই সরকারের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে যাবে৷