এতদিন পরেও চিকিৎসার জন্য দাক্ষিণাত্যই কি ভরসা ?
৯ সেপ্টেম্বর ২০২১বেসরকারি হাসপাতাল কমিশনের বক্তব্য নস্যাৎ করেছে৷ এই চাপানউতোরে জনতার প্রশ্ন, তাদের চিকিৎসার খরচ কমবে কীভাবে?
চিকিৎসার ক্ষেত্রে বাঙালির দাক্ষিণাত্য প্রীতি আজকের নয়৷ বহু বছর ধরেই বাঙালি রোগীরা দক্ষিণের হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা নিতে যান৷ যদিও পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসা পরিষেবায় অনেক উন্নতি হয়েছে৷ সরকারি আর বেসরকারি মিলিয়ে প্রচুর হাসপাতাল৷ তা সত্ত্বেও ফি বছর বাঙালি চিকিৎসা করাতে দাক্ষিণাত্যে যায়৷ কেন? স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারম্যানের মন্তব্যে সামনে এসেছে খরচ নিয়ে বিতর্ক৷ তামিলনাড়ুর ভেলোরে অবস্থিত ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নজির টেনেছেন চেয়ারম্যান অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তার মন্তব্য, "ভেলোরে এত রোগীর ভিড় করার উত্তর লুকিয়ে আছে ওই হাসপাতালের বিলে৷” কী কারণে এমন মন্তব্য কমিশনের?
রাজ্যের সব বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ভেলোর হাসপাতালের বিল৷
ঘটনার সূত্রপাত
বারাকপুরের বিকাশ মণ্ডল বেসরকারি হাসপাতালের লাগামছাড়া বিলিং নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন স্বাস্থ্য কমিশনে৷ বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি আনন্দপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন৷ ১০ দিনে বিল হয় চার লাখ ৯৭ হাজার টাকা৷ পা বাদ যেতে পারে বলেও জানান ডাক্তাররা৷ এরপরেই বিকাশের পরিজনেরা তাকে তড়িঘড়ি ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে নিয়ে যান৷ ভেলোরে ১৯ দিনে বিল হয় ১ লক্ষ ১৯ হাজার টাকা৷ পা বাদ যায়নি৷ অবশেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন বিকাশ৷ তার অভিযোগই কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের বিল নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে৷
ভেলোরে বিকাশের চিকিৎসার বিল স্বাস্থ্য কমিশন কলকাতার নানা বেসরকারি হাসপাতালে পাঠাচ্ছে৷ কমিশন চাইছে, ভেলোরের বিল দেখে বেসরকারি হাসপাতালগুলি শিক্ষা নিক৷ যদিও বেসরকারি হাসপাতালগুলি স্বাস্থ্য কমিশনের এই উদ্যোগে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে৷
কেন দক্ষিণ ভরসা?
কল্যাণীর সুপ্রতিম সরকার বাবার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির জন্য দক্ষিণ ভারতে রয়েছেন৷ কেন দক্ষিণে গেলেন? সুপ্রতিম বলেন, "কলকাতায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার গলাকাটা খরচ যেমন, তেমনই পরিষেবাও ঠিক পাই না৷ সরকারি হাসপাতালে চূড়ান্ত অব্যবস্থা, ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগই হয় না৷ ফলে দক্ষিণে যাওয়াটা নিরাপদ৷” সুপ্রতিমের কথার সারবত্তা আছে বলে মত সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের চিকিৎসক স্বপন বিশ্বাসের৷ তিনি বলেন, "এ জন্য দায়ী সরকারি স্বাস্থ্যনীতি৷ আজ পশ্চিমবঙ্গে কর্পোরেটমুখী স্বাস্থ্য পরিষেবা৷ তুলনামূলকভাবে হয়তো ভেলোরে কিছুটা সস্তা৷” তার মতে, "পরিসংখ্যানই বলছে, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা গড়ে একজন রোগীকে ৪০ সেকেন্ড সময় দেন৷ সেটা বেশি সময় হলে রোগীরা সন্তুষ্ট হতেন৷ জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ হাসপাতাল বাড়েনি সেই অনুপাতে৷ ফলে পরিকাঠামোর অভাব থাকবেই৷”
সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো পর্যাপ্ত নয়৷ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ কিংবা জটিল স্নায়ু চিকিৎসা, কিডনি বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, রক্তের ক্যান্সারের মতো গুরুতর চিকিৎসা কেবলমাত্র দু-একটি সরকারি হাসপাতালে হয়৷ তাছাড়া সরকারি হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের অন্যান্য চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘ লাইন৷ তাই গলাকাটা খরচ সত্ত্বেও বেসরকারি হাসপাতালে জেনেশুনে মানুষকে যেতে হয়৷
এরই মধ্যে বেহালার একটি নার্সিংহোমে সোডিয়াম, পটাসিয়াম কমে যাওয়া নিয়ে একজন ভর্তি হলে মাত্রাছাড়া বিল করা হয়েছে৷ এমন নজির ভূরি ভূরি, তার কতটা সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে! ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ বলেন, "বেসরকারি পুঁজির মালিকরা লাভের জন্য বেশি বিল করবেই৷ খরচ যেমন একটা বিষয়, তেমনি এখানে পরিষেবা রোগীবান্ধব নয়, তাই মানুষকে চিকিৎসার জন্য দক্ষিণে যেতে হয়৷”
স্বাস্থ্য কমিশনের পদক্ষেপ
চার বছর ধরে রাজ্যের স্বাস্থ্য কমিশনে মানুষ অভিযোগ জানাচ্ছেন৷ ছোট-বড় বেসরকারি নার্সিংহোম বা হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি দেখলে চমকে উঠতে হয়৷ এক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগীর বিলের অঙ্ক অস্বাভাবিক বেশি এবং তা কোনোভাবেই পরিষেবার সমতুল নয়৷ এমনকি চিকিৎসার বিল বাড়াতে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ওষুধের ব্যবহার করা হয়৷ চিকিৎসার মূল খরচের তুলনায় আনুপাতিক হারে আনুষঙ্গিক খরচ বেশি৷ যদিও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব মানতে নারাজ৷ ভেলোরের বিল প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ডাঃ কুণাল সরকার বলেন, "কমিশনের তুলনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়৷ কমিশনের মন্তব্যও বিবেচনাপ্রসূত নয়৷ কলকাতা আর ভেলোর পাঞ্জা লড়াই করছে না৷ ভেলোর আমাদের কাছে নমস্য প্রতিষ্ঠান৷”
বরং ডাঃ সরকার স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যকেই ‘বিভ্রান্তিকর' বলেছেন৷ বিকাশের চিকিৎসা প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "একটা নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে৷ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালটি যথেষ্ট ভালো চিকিৎসা করেছে৷ চারটে অপারেশন করতে হয়েছে বলে এই বিল হয়েছে৷”