‘কৃত্রিম জঙ্গিবাদ টিকবে না’
১১ এপ্রিল ২০১৭ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কি হঠাৎ করেই আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে?
মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ: এগুলোকে আমি আত্মঘাতী হামলা বলব না৷ বরং আমি বলতে চাই, জঙ্গিরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে৷ জঙ্গিদের এই পথ বেছে নেওয়ার মূল কারণটা হচ্ছে, তারা নিজেদের অত্যন্ত দুর্বল মনে করছে৷ তারা প্রতিরোধের মুখে পড়ে আত্মসমর্পণ করছে না, আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে৷
কেন জঙ্গিরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে?
আমি তো আগেই বলেছি, এটা তারা করছে দুর্বল মানসিকতা থেকে৷ কারণ তাদের সংগঠনে একটা অস্তিত্বের সংকট চলছে৷ এই পরিস্থিতিতে এটাকে তারা দেখছে বীরোচিত আত্মত্যাগ হিসেবে৷ পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া একটা ব্যাপার৷ কিন্তু এক্ষেত্রে তারা প্রচার চালাচ্ছে যে, আমাদের সংগঠনের লোকজন বীরের মতো যুদ্ধ করে মরেছে৷
এই আত্মঘাতীদের ঠেকানোর কি কোনো কৌশল আছে?
আমি বলব, এটা মতাদর্শের লড়াই৷ খণ্ডিতভাবে ধর্মপ্রচার করে যারা আত্মঘাতী হচ্ছে, তাদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে, এভাবে মৃত্যু হলে তারা বেহেস্তে চলে যাবে৷ জিহাদ করা তাদের ইমানী দায়িত্ব৷ এখানে মূল দায়িত্ব হচ্ছে সমাজ ও পরিবারের সচেতনতা৷ পাশাপাশি এরা যে মতাদর্শ ছড়াচ্ছে, সেটা ছড়ানোর যে ম্যাকানিজম আছে, সেটা নষ্ট করতে হবে বলে আমার মনে হয়৷ এটা শক্তির বিষয় না, বোঝানোর বিষয়৷ তাই এখানে সমাজ ও পরিবারের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বলে আমি মনে করি৷ পাশাপাশি এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকাও দেখতে চাইছি আমি৷
জঙ্গিদের আত্মঘাতী স্কোয়ার্ড গঠনে বাইরের কোনো চক্র কাজ করছে কি?
আমি মনে করি, আত্মঘাতী হওয়াটা তাদের একটা কৌশল৷ আমার ধারণা, বাংলাদেশে আত্মঘাতীদের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল৷ খুব কম লোকই ওদের দ্বারা ‘মোটিভেটেড' হয়েছে, হচ্ছে৷ এর মধ্যে অনেকে আবার মারাও গেছে৷ ওদের আত্মঘাতী হওয়ার সঙ্গে আমি অন্য কিছু মেলাতে চাই না৷ তবে জঙ্গি সংগঠনগুলোর উত্থানের পেছনে দেশি ও বিদেশি লোকজনের যে মদদ থাকে, সেটা অনেকটাই পরিষ্কার৷
যারা আত্মঘাতী হচ্ছে, তাদের মধ্যে শিতি না অশিতি বেশি?
আমরা দু'টো দিকেই দেখতে পাচ্ছি৷ পুলিশের একটা গবেষণায় উঠে এসেছে যে, আমাদের দেশে সবচেয়ে উচ্চবিত্ত ও সবচেয়ে নিম্নবিত্তদের মধ্যে জঙ্গি হওয়ার প্রবণতা সবচাইতে বেশি৷ অর্থাৎ ‘মেইন স্ট্রিম পপুলেশন' থেকে জঙ্গি বেশি হয়নি৷ এতে বোঝা যায় যে, সমাজে ঐ দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে বঞ্চনা এবং হতাশা আছে৷ আর সেটাই লাজে লাগাচ্ছে তারা৷ আর যেহেতু ‘মেইন স্ট্রিম পপুলেশন' থেকে জঙ্গি তৈরি হয়নি, সেহেতু আমি বলব আমরা ভালোই আছি৷
জঙ্গি দমনে গোয়েন্দারা যে পথে যাচ্ছে, সেটা কি সঠিক পথ?
জঙ্গি বিরোধী কৌশল হলো – জঙ্গিরা যেভাবে কৌশল পরিবর্তন করে, গোয়েন্দাদেরও একইভাবে কৌশল পরিবর্তন করতে হয়৷ সময়ের সাথে সাথে এটা পরিবর্তন না হলে তারা ‘ম্যাচ' করতে পারে না৷ এই মুহূর্তে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে আমি মনে করি গোয়েন্দাদের কৌশল কাজে দিচ্ছে৷ আমাদের গোয়েন্দারা জঙ্গিদের ওপর চড়ে বসেছে৷ তাদের আস্তানা আবিষ্কার হচ্ছে, জঙ্গিদের ধরতে পারছে জঙ্গিরা৷
জঙ্গিদের এই প্রবণতা রোধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কি যথেষ্ট?
পদক্ষেপের অনেকগুলো ভাগ আছে৷ জঙ্গি বিরোধী যে পদক্ষেপটা এখন দেখছি, সেটা কাজে লাগছে৷ জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে৷ আরেকটি হলো মতাদর্শিক লড়াই৷ এটা অহিংস পন্থা৷ জঙ্গিদের যে পৃষ্ঠপোষকরা সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করা৷ এর জন্য বহুমুখী কৌশলের প্রয়োজন৷ আমদের রাষ্ট্র এখনও বহুমুখী কৌশল রপ্ত করতে পারিনি৷ তবে নানাভাবে কাজ হচ্ছে৷ এগুলোর সমন্বয় করে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে কাজ হবে৷
এদের ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ কি নেওয়া সম্ভব?
এখানে আমি রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ দিতে চাই৷ যারা জঙ্গিত্ব থেকে ফিরে আসতে চায়, রাষ্ট্র তাদের ফিরে আসার রাস্তাটা খুলে দিয়েছে৷ এর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা হয়ত এখনও আমরা অনুধাবন করতে পারছি না৷ কিছু জঙ্গি ইতিমধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে৷ আর যারা আত্মঘাতী, তারা ‘হাইলি ডেডিকেটেড'৷ যারা আত্মঘাতী, আপনি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবেন না৷ কারণ তারা হিজরত করে সবসময় গোপন আস্তানায় থাকছে৷ এখন যদি তাদের ভেতরে কোনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় বা তারা ব্যাপারটা ‘রিয়েলাইজ' করে, তাহলে হয়ত তারা ফিরে আসবে৷ তাকে ‘মোটিভেট' করার সদিচ্ছা আপনার থাকলেও, আপনি তো তার কাছে পৌঁছাতে পারছেন না৷ এই জটিলতা মেনেই আমাদের এগোতে হবে৷
কোন প্রেক্ষাপটে জঙ্গি প্রবণতা বাড়ে, মানে দেশে কি এমন কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে?
আমি মনে করি না যে, দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ আমাদের তিন হাজার বছরের সংস্কৃতি, যেখানে সহিষ্ণুতা ছিল৷ এ দেশে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করে৷ এখানে সংস্কৃতির একটা বড় ভিত্তি আছে৷ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ আমরা আগে দেখিনি৷ তাই আমি মনে করি না যে, এখানে জঙ্গিবাদ শেকড় গাড়তে পারে৷ তবে দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকরা নানারকম জঙ্গি মতাদর্শ তৈরি করে কৃত্রিমভাবে তা বপন করছে৷ এখানে পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্ত করে তাদের পেছন থেকে সরিয়ে আনা গেলে জঙ্গিবাদ আপনা-আপনি নুইয়ে যাবে৷ তাছাড়া আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নতির দিকে৷ এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে এই উন্নয়ন যাতে সবাই ভোগ করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা৷ সুতরাং কৃত্রিমভাবে যেটা করা হচ্ছে, সেটা টিকবে বলে আমি মনে করি না৷ জনগণও এদের সমর্থন করে না৷
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধেরকিছু মানবিক প্রশ্ন আসে৷ শক্তি প্রয়োগ করলে সেখানে কিছু মৃত্যু ঘটে৷ আর তাতে সাধারণ মানুষ মারা যান, জঙ্গিরা মারা যায় এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মারা যান৷ এতে একটা স্পর্শকাতরতা তৈরি হয়৷ শক্তি প্রয়োগের সময় আপনি যত মানবিক থাকবেন, জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে ততটাই সুফল পাবেন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷