প্রশ্নবিদ্ধ সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানার্জনের শুভ উদ্যোগ
২ সেপ্টেম্বর ২০২২নবীরুল ইসলাম বুলবুল তালিকায় শুধু নিজের ২৯টি কবিতার বই রাখেননি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওই তালিকা প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্রয় কমিটির প্রধান হিসেবে৷ আর ‘মৃত্তিকা প্রকাশন' নামে যে প্রকাশনী থেকে তার বই বের হয়েছে সেটিও তার নিজের৷ তার মেয়ের নামে প্রতিষ্ঠানটির নাম৷
সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞান চর্চা ও পাঠাভ্যাস’ গড়ে তোলার জন্য গত অর্থ বছরে হঠাৎ করেই বই কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়৷ তবে এটা কোনো নিয়ম-নীতি মেনে করা হয়নি৷ কোনো প্রকল্প ছাড়াই ‘বইপত্র ও সাময়িকী' খাত থেকে চার বছরের জন্য মোট বরাদ্দ করা হয় ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা৷ গত বছরই এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে৷ তবে বই বাছাই করতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়৷ কমিটির প্রধান হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নবীরুল ইসলাম বুলবুল৷ কমিটির সদ্যদের মধ্যে আরো একজন অতিরিক্ত সচিব এবং তিন জন উপসচিব আছেন৷
তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশফাকুল হক চৌধুরির স্বাক্ষরে বইয়ের তালিকা পাঠানো হয় মাঠ প্রশাসনে৷ তবে নবীরুলই মূলত বইয়ের তালিকার নাম ঠিক করেন৷ এটা করতে গিয়ে তিনি তালিকায় তার নিজেরই ২৯টি বই রেখেছেন ৷ তালিকায় মোট বই এক হাজার ৪৭৭টি৷
উপসচিব আশফাকুল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি ডেস্ক অফিসার হিসেবে তালিকায় সই করেছি৷ এই তালিকা কিভাবে তৈরি হয়েছে আমার জানা নেই৷ উপর থেকে ঠিক করা হয়েছে৷’’ মন্ত্রণালয় থেকে ডয়চে ভেলেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটির কথা নিশ্চিত করে তাকে কমিটির একজন সদস্য বলা হলেও তিনি কমিটিতে থাকার কথা অস্বীকার করেন৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা ডেস্ক অফিসাররা আদীষ্ট হয়ে কাজ করি৷ আপনারা তো এটা জানেন৷’’ আর ওই কমিটির ‘সেকেন্ড ম্যান’ অতিরিক্ত সচিব আবুল হাসনাত হুমায়ূন কবির এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে মন্ত্রী বা সিনিয়র সচিব কথা বলতে পারবেন৷ আর কেউ নয়৷ তারা যা বলার বলে দিয়েছেন৷’’
মাঠ প্রশাসনে বই কেনা
দুইজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং দুইজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা বরাদ্দের টাকা দিয়ে এরই মধ্যে বেশ কিছু বই কিনেছেন৷ একজন জেলা প্রশাসক জানান, ‘‘এর বাইরে প্রতি বছর জেলা প্রশাসকের অফিস লাইব্রেরির জন্য বই কিনতে ৩০-৪০ হাজার টাকা দেয়া হয়৷ এই টাকা দিয়ে কী ধরনের বই কিনতে হবে তারও নির্দেশনা থাকে৷ তালিকায় সব সময়ই প্রশাসনের সিনিয়র অফিসারদের বই থাকে৷ আমাদের তা কিনতে বাধ্য করা হয়৷’’ তবে উপজেলা প্রশাসনের জন্য নিয়মিত আলাদা বরাদ্দ থাকে না৷ তবুও তারা প্রয়োজনে কিছু বই কেনার চেষ্টা করেন৷ আবার কোনো সিনিয়র কর্মকর্তার বই অনেক সময় সুপারিশের কারণে কিনতে হয়৷ একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দাবি করেন, ‘‘বসদের বই কেনার জন্য অনুরোধমূলক আদেশ আমরা পাই৷’’
আলোচিত এই বই কেনার জন্য দেশের ৪৯৫টি উপজেলায় প্রতিটিতে এক লাখ ৫০ হাজার, ৬৪ জেলার প্রতি জেলায় দুই লাখ এবং আট বিভাগে তিন লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷ চার বছরের মধ্যে ওই টাকায় বই কিনতে বলা হয়৷ গত অর্থ বছর থেকেই বই কেনা শুরু হয়েছে৷ কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি ছোট আকারের পাঠকক্ষ গড়ে তোলাও এর উদ্দেশ্য৷ তবে জেলা প্রশাসকের অফিসে আগে থেকেই লাইব্রেরি ও একজন লাইব্রেরিয়ান আছেন৷
যেভাবে তালিকা করা হয়
আলোচিত এই কমিটির একজন সদস্য জানান, তালিকা তৈরির করার জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে বইয়ের একটি তালিকা আনা হয়৷ সেই তালিকা সামনে রেখে নবীরুল ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী তার নিজের এবং অন্যান্য আমলাদের বই দিয়ে তালিকা চ‚ড়ান্ত করা হয়৷ এই তালিকায় ২৫ জন আমলার চার-পাঁচটি করে বই আছে৷ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তালিকায় থাকা ১৬৬টি বইয়ের মধ্যে কমপক্ষে ৪০টি বই লিখেছেন ১৫ জন সরকারি কর্মকর্তা৷ তালিকায় আছে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের লেখা বই৷
তবে তালিকায় আইন-কানুন, দাপ্তরিক বিভিন্ন জরুরি প্রসঙ্গ, ইতিহাস ও দর্শনের প্রয়োজনীয় বইও রয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের বইও আছে৷
তবে তালিকায় এটা স্পষ্ট যে, বই এবং বইয়ের লেখকদের একটি অংশ অপরিচিত৷ তারা মূলত ক্ষমতা, যোগাযোগ ও বিষয়কে কাজে লাগিয়ে তালিকায় নাম ঢুকিয়েছেন৷
নবীরুল ইসলাম বুলবুল কৌশলে তালিকায় এক জায়গায় পর পর তার বইগুলো রাখেননি৷ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রেখেছেন, যাতে চোখে না পড়ে৷ নবীরুল ছাড়া যেসব লেখকের একাধিক বই আছে সেই বইয়গুলোর নাম একসঙ্গেই আছে৷
নবীরুলই প্রকাশক
নবীরুলের বইগুলো প্রকাশ করেছে ‘মৃত্তিকা প্রকাশন’৷ প্রকাশক মহলে খোঁজ নিয়ে এই ধরনের কোনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তবে জানা গেছে যে, ‘মৃত্তিকা প্রকাশন’ নবীরুলের বই-ই প্রকাশ করেছে৷ তার মেয়ে আনিকা প্রিয়দর্শিনী মৃত্তিকা তার বইয়ের প্রকাশক৷ আর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি নাম তার মেয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে৷ ঢাকার মিরপুরের জয়নগর অফিসার্স গভর্নমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা ব্যবহার করেছে প্রকাশনা সংস্থাটি৷ তবে বাস্তবে সেখানে অফিস এখনো নেই৷ সরকারি কর্মকর্তাদের ওই আবাসন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ এখানো চলছে৷
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ‘‘মৃত্তিকা প্রকাশন আমাদের সদস্য নয়৷ আর বাস্তবে এই প্রকাশনীর কোনো অস্তিÍত্ব নেই৷ নবীরুল সাহেব নিজেই একটি প্রকাশনী বানিয়ে তার নিজের বই নিজের পয়সায় ছাপেন৷ আর বিভন্ন দপ্তরে যখন ছিলেন, তখন তার মাধ্যমে বিক্রি করেছেন৷ অন্য প্রকাশকরা তার অল্প কিছু বই ছেপে থাকতে পারে৷ আর তার বই কোথায় পাওয়া যায় তা-ও আমরা জানি না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রধানত বই কেনে৷ জাতীয় গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন৷ জনপ্রশসন মন্ত্রণালয়ের বইয়ের তালিকা দেখে মনে হয়েছে তারা ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা না করেই নিজেদের স্বার্থে তালিকা করেছে৷ আমলাদের বই তালিকায় ঢুকানোই ছিল মূল টার্গেট৷’’
‘তালিকা বাতিল হলেই দুর্নীতি মুছে যায় না’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ব্যাপক সমালোচনার মুখে বইয়ের তালিকা বাতিল করেছে৷ ওই মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম তখন সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেন ওই তালিকা সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না৷ এমনকি কোনো কমিটি থাকার কথাও তিনি অস্বীকার করেন৷ কিন্তু খোঁজ-খবর নিয়ে বই বাছাইয়ের জন্য নবীরুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটির কথা জানা যায়৷ তিনি প্রশাসন অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হওয়ায় তাকেই কমিটির প্রধান করা হয়৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘তালিকা বাতিল করা ইতিবাচক, তবে এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে৷ নিজে প্রকাশনা সংস্থা করে নিজের বই ছেপে আবার তা সরকারি অর্থে কেনার ব্যবস্থা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এরইমধ্যে বই কেনাও হয়েছে৷ তাই সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘এর নীতিমালা ও স্বচ্ছতা থাকা দরকার৷ বই কেনা হবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বইয়ের গুণগত মান দেখে৷ কোনো দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়৷ কিন্তু আমাদের দেশে একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে সব খানেই দলীয় বিবেবচনায় সবকিছু করার চেষ্টা হয়৷’’
সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘‘আমাদের সময় আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য যেসব বই কিনতাম তা কমিটির মাধ্যমেই কিনতাম৷ আমরা বিবেচনা করতাম প্রয়েজনীয়তার বিষয়৷ ডিসি সাহেবরা যে বইগুলো কিনবেন, তা হতে হবে অ্যাকাডেমিক এবং টেকনিক্যাল৷’’
তিনি বলেন, ‘‘অতিরিক্ত সচিবের ২৯টি কবিতার বই তালিকায় থাকা আমাকে বিস্মিত করেছে৷ তিনি নিজে যেহেতু তালিকা করার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই তার নিজের বই সেখানে রাখা ঠিক হয়নি৷ তার উচিত ছিল নিজেকে কমিটির বাইরে রাখা৷ এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেষ্ট হয়েছে৷ নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷’’
তার কথা, ‘‘আমলারা সাহিত্য চর্চা করবেন এতে কোনো বাধা নেই৷ অনেক আমলা খ্যাতিমান সাহিত্যিক৷ কিন্তু অতিরিক্ত সচিব মহোদয়ের বই কত জন পড়েন তা-ও তো দেখতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকারের বিভিন্ন বিভাগ বই কিনবে অ্যাকাডেমিক প্রয়োজনে৷ অ্যাকাডেমিক উন্নয়নের জন্য৷ সেখানে তো মতাদর্শের বই কেনার প্রয়োজন নেই৷ তবে অনেকে রাজনৈতিক বিবেবচনার অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ঐতিহ্যের বইয়ের বিরোধিতা করেন৷ সেটা গ্রহণযোগ্য নয়৷ মনে রাখতে হবে ৭০-এর নির্বাচনে ২৫ ভাগ লোক বাংলার মানুষের পক্ষে ভোট দেননি৷ তারা তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না৷’’
এদিকে নবীরুল ইসলাম আপাতত চুপ রয়েছেন৷ তিনি তার দপ্তরেও যাচ্ছেন না বলে জানা গেছে৷ গত মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের মাসিক বৈঠকেও তিনি ছিলেন না৷ তাকে ফোন করে, মেসেজ পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি৷ জনপ্রশাসন সচিবও এখন সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন৷