মাতৃভাষাই যে একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়, মাতৃভাষার মাধ্যমেই যে মানুষ তার আত্মপরিচয়কে প্রকাশ করতে পারে-বায়ান্নর একুশ তার নজির স্থাপন করেছিল গোটা বিশ্বে। মূলত আটচল্লিশ সাল থেকে শুরু হওয়া বাংলা ভাষার আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এখানে বলে নেওয়া ভালো, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনটি শুরু হলেও, তার অন্তর্নিহিত বার্তা ছিল প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে তার মাতৃভাষায় কথা বলার, রাষ্ট্রীয় কাজে অংশ নেওয়ার। আর এ কারণেই একুশের চেতনা আজ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বাংলার মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের যে সাহসী আখ্যান-একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- সে যুদ্ধও কেবল বাঙালির ছিল না। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বটে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকায় চাকমা-মারমা-গারো-সাঁওতাল-হাজংসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শহিদদের পবিত্র রক্ত মিশে আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ তা-ই বাংলার স্বাধীন মানুষের বাঁচা-মরার লড়াইয়ে রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস জেনোসাইডের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের যে অমিত উত্থান-তার সার্বজনীনতার উৎসই হলো বায়ান্নর একুশ।
তাই বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে একুশ আমার অহংকার। আর এ অহংকার জাতি হিসেবে কেবল বাঙালি জাতির একার নয়; বরং বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠীর। প্রতিটি জাতি তার নিজ নিজ মায়ের ভাষার কাছে এই গৌরবের অঞ্জলি নিয়ে হাঁটুমুড়ে বসে। মাতৃভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মেধাবী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তাই একুশ মানে মাথা নত না করা-কেবল বাঙালির উচ্চারণ নয়; বরং প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব অহম।
মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেওয়া জাতির কাছে তার মাতৃভাষা কতটা প্রিয়. তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাতৃভাষার মর্যাদা যে জাতি উপলব্ধি করতে পারে, তারাই পারে সকলের মাতৃভাষাকে সম্মান করতে। এই শিক্ষাই একুশ আমাদের দিয়েছে। আর একুশের এ শিক্ষার হাত ধরেই প্রতি ভাষার মাসে আসে প্রাণের বইমেলা। যে সকল ভাষাভাষির মাতৃভাষার লেখ্যরূপ আছে তারা নিজ ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন। সেই সাহিত্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাচ্ছে।
একসময় ভাষাচর্চার জন্য বই-ই একমাত্র মাধ্যম ছিল। স্বাধীন স্বদেশে বইমেলা করার স্বপ্ন দেখেন মুক্তধারা প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। বাহাত্তরের একুশের আয়োজনে মাঠের মাঝে চাদরের ওপর বিছিয়ে বসে সেই যে মেলার সূচনা করেছিলেন তিনি, সেই মেলা আজ মহীরূহ। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে এই মেলার ব্যাপ্তি এখন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলা এখন বিশ্বের অন্যতম বড় পরিসরের বইমেলা হিসেবে পরিচিত। পুরো মাসজুড়ে বইমেলার এমন আয়োজন বোধ করি আর কোনো দেশে নেই। বইমেলা এখন আমাদের উৎসবে পরিণত হয়েছে। সারা মাসজুড়ে পাঠক-লেখক-প্রকাশকের এমন মিলনমেলা সত্যিই অভাবনীয়। এ বছর মেলায় প্যাভিলিয়ন সংখ্যা ৩৪ টি। স্টল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭৩৮ টি, বাংলা একাডেমিতে ১৭৫ টি। শিশু চত্বরে স্টল রয়েছে ৭৫টি। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে স্টল ১৬০টি। মেলার প্রথম সপ্তাহে নতুন বই এসেছে ৪১৮ টি।
স্বনামধন্য বড় প্রকাশকদের পাশাপাশি কম পরিচিত বহু প্রকাশক আসেন অমর একুশের এই বইমেলায়। তবে ব্যাপ্তির কারণেই হোক বা উদাসীনতা কিংবা ব্যক্তিগত প্রীতির কারণেই হোক, বহু প্রকাশকের কাজ তেমনভাবে যাচাই করে না বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। মেলার মাঠে মাইকে যখন জমা পড়া বইয়ের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন কিছু কিছু নাম শুনে থমকে যাই, চমকে উঠি; এই কী আমার একুশের চেতনা! কোন কোন বইয়ের বিষয় তো সভ্যতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। কোন কোন লেখক ভাষাকে একেবারে ভুলবাবে উপস্থাপন করে এমন এক মিশ্র ভাষার জন্ম দেন, যা সত্যিই দুঃখজনক। যেসব শব্দ সেখানে ব্যবহৃত হয়, তা না কানে শোনার যোগ্য, না মুখে বলার-এমনকি বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও নয়। তাই একজন পাঠক হিসেবে আমি মনেই করি প্রকাশকদের কাজও যাচাই-বাছাই করার দরকার রয়েছে।
মেধাসত্ব আইন বা লেখকের পারিশ্রমিকের বিষয়টি নিয়েও স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। মেলা কেবল বইয়ের বলেই হয়ত, বই নিয়ে দুয়েকটি কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে যতগুলো বই প্রকাশিত হয় মেলায়, তার মান নিয়েও পাঠক মনে নানা সংশয় থাকে। এর প্রধান কারণ, অসম্পাদিত অবস্থায় বই প্রকাশ। বাংলাদেশের বই প্রকাশের সংস্কৃতিতে সম্পাদনার বিষয়টি এখনও গুরুত্বের সাথে উঠে আসেনি। গুটি কয়েক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনী ছাড়া পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না৷ কিন্তু বই লেখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার যথাযথ সম্পাদনাও গুরুত্বপূর্ণ৷ সম্পাদনা মানে কেবল প্রুফ রিডিং নয়, এ পেশাদারত্বটুকু এখনও বাংলাদেশের প্রকাশনার জগতে যুক্ত হয়নি। আবার তথ্যসূত্র যাচাই-বাছাই কিংবা প্লেজারিজমের বিষয়টিও আলোচনায় আসে কম। ফলে পাঠক বই কিনে অনেক সময়ই বিভ্রান্ত হন। পাঠকের অর্থনাশ ঘটে। এতে বইমেলার সার্বিক যে বিন্যাস, যে চিন্তা-তা বাধাগ্রস্ত হয়।
বইমেলায় শিশু প্রহর থাকে। শিশুরা তাদের অভিভাবকদের হাত ধরে আসেন মেলায়। আমার পর্যবেক্ষণ, শিশুরাই বেশি বই কেনেন; অন্যভাবে বলা যায়, অভিভাবকরা সন্তানদের জন্যই বেশি বই কেনেন৷ তবে আমরা লেখকরা বা প্রকাশকরা শিশুদের প্রতি তেমন সুবিচার করি বলে মনে হয় না। লেখকরা ভুত-প্রেতের কিংবা অতিপ্রাকৃত গল্প লেখাতেই বেশি আগ্রহী। তারা মনে করেন, শিশুদের জন্য যেন ওগুলোই কেবল উপযোগী। তাছাড়াও যে শিশুসাহিত্যের আরও নানা অংশ রয়েছে, সেদিকে আমরা তেমন মনোযোগী হই না। এমনকি অনুবাদ যে শিশুসাহিত্যের একটি বড়ো ভাণ্ডার তৈরি করতে পারে, সে বিষয়েও আমরা খানিকটা উদাসীনই থেকে গেলাম। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শিশুতোষ রচনা ছাড়াও আদর্শভিত্তিক রচনারও বড়ই অভাব। অথচ এ ধরণের রচনাই তৈরি করবে শিশুর মনন, গড়ে তুলবে তার বোধ।
একুশের আদর্শভিত্তিক রচনা, এ ভূখণ্ডের ইতিহাস-ঐতিহ্যভিত্তিক রচনা, বিশ্ব-ঐতিহ্য, সভ্যতাভিত্তিক রচনারও অভাববোধ করি একজন পাঠক ও শিক্ষক হিসেবে। এছাড়াও মেলার পরিবেশ নিয়ে, ধুলো নিয়ে কত কথা হয়, আয়োজকদের সমালোচনা হয়; কিন্তু যে বই নিয়ে এই মেলা, সে বইয়ের মান নিয়ে খুব একটা আলোচনা হতে দেখা যায় না। বইমেলার প্রাণ বই সেই বইয়ের মান নিশ্চিত করা সব কিছুর আগে প্রয়োজন। তারপর ক্রেতার সুবিধা বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।