একদিনে ১৩টি মৃত্যুদণ্ড
১১ মার্চ ২০১৬মানবাধিকার সংস্থার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অববস্থান খুব যৌক্তিক এবং মানবিক৷ আধুনিক বিশ্বে অনেকটা ‘খুনের বদলা খুন'-এর মতো যুক্তিতে হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না হওয়া অবশ্যই ভালো৷ এক হত্যায় এক মায়ের বুক খালি তো হয়েছেই, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরেক মায়ের বুক খালি করা কি ঠিক? এই ঠিক-বেঠিকের মাঝখানে এখনো বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দাঁড়িয়ে৷ একুশ শতকে এসে হাতে গোনা কয়েকটি দেশই শুধু মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে৷
অনেক দেশে বাতিল হয়নি বলে বাংলাদেশেও হবে না – এমনটি ধরে নেয়ার কোনো মানে নেই৷ এমন দিন হয়ত আসবে যখন বাংলাদেশেও আর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকবে না৷ কিন্তু যতদিন আছে ততদিন তো আদালতে সর্বোচ্চ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হবে৷ এখনো তা-ই হচ্ছে৷ কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কেন যেন সবসময় সরব হচ্ছে না৷ শুধু মাঝে মাঝে সরব হওয়ার কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজটি কঠিনই থেকে যাচ্ছে৷
বাংলাদেশে অনেক অপরাধীর বিরুদ্ধেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত৷ এখনো দিচ্ছে৷ কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সব মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ বা নিন্দা জানাতে দেখা যায় না৷ প্রশ্ন হলো, মৃত্যুদণ্ডই যদি সবচেয়ে বড় আপত্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিবাদ, নিন্দায় কেন ধারাবাহিকতা নেই?
প্রতিবাদ, নিন্দার ধারাবাহিকতা থাকলে আজ বিশ্বের সব দেশের সংবাদমাধ্যমে নিশ্চয়ই ছাপা হতো একটি খবর, যার শিরোনাম হতো, ‘বাংলাদেশে একদিনে ১৩টি মৃত্যুদণ্ড, মানবাধিকার সংস্থার তীব্র প্রতিবাদ৷' কিন্তু সেরকম খবর দেখছি না তো!
বাংলাদেশের পাঠকপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী, বুধবার বাংলাদেশের দু'টি আদালত ১১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে৷ খবরে জানানো হয়, ২০১১ সালে স্কুল ছাত্র হিমেল দাশ সুপনকে হত্যা করার দায়ে ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২৷ একই দিনে রংপুরের আদালত ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ পীরগঞ্জের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীকে হত্যার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে এই রায় দেয় রংপুরের আদালত৷
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবরে অবশ্য একই দিনে চার মামলায় কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে৷
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই ১১ বা ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই৷
অথচ বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত যে সাতজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকের বেলায়ই প্রতিক্রিটা খুব তড়িৎ ছিল৷ কখনো কখনো মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়ায় তুমুল বিতর্ক, ব্যাপক বিক্ষোভও হয়েছে৷
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতির প্রতিবাদে বাংলাদেশে বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে৷ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার তখন অ্যামনেস্টিকেই ‘মানবতাবিরোধী' বলেছিলেন৷ অ্যামনেস্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার দাবি করায় ইমরান ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় বোমা মেরে নারী-শিশুসহ মানুষদের হত্যা করে তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মানবাধিকারের উদয় হয় না৷ এখন তারা মার্কিনীদের দোসর পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মুক্তির দাবি করছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে৷ তাদের এই বিবৃতি প্রমাণ করে, অ্যামনেস্টি এখন আর কোনো মানবাধিকার সংগঠন নয়, তারা মানবতাবিরোধী সংগঠন, একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন৷'' অ্যামনেস্টিকে ‘জঙ্গিবাদী সংগঠন' বলার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে লন্ডনে অ্যামনেস্টির প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার বরখাস্ত হওয়ার দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছিলেন ইমরান এইচ সরকার৷
ঘটনাটি সেখানেই থেমে থাকেনি৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার চাওয়ায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে ক্ষমা চাইতে বলে চিঠিও লিখেছিল বাংলাদেশ সরকার৷
মৃত্যুদণ্ড প্রশ্নে অ্যামনেস্টিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আবার নীরব৷ এই নীরবতার কারণ কী? প্রত্যেক ক্রিয়ার বা কাজের প্রতিক্রিয়া তো একই হওয়া উচিত৷ মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্নে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া সবসময় একরকম নয় কেন?
মানবাধিকার সংস্থাগুলির কি সব মৃত্যদণ্ডের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করা উচিত নয়? জানান নীচের ঘরে৷