একটি বিভক্ত দেশ
৩ অক্টোবর ২০১৫কথা হচ্ছিল জার্মান পুনর্মিলন নিয়ে৷ তাহলে একটু খুলে বলি...
বন থেকে ট্রেনে ওয়ারশ গেছিলাম আমার গিন্নির এক প্রবীণ আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে৷ পশ্চিম জার্মানি যখন এফআরজি ছিল, আর পূর্ব জার্মানি জিডিআর, সে আমলের কথা৷ জার্মানির তখন যে দশা, অর্থাৎ বিভাজন, তা তখন ইউরোপেরও ছিল৷ ভালো বাংলায় বলা হতো লৌহ যবনিকা৷ সেই যবনিকার এপারে আর ওপারে আকাশপাতাল তফাৎ৷
কমিউনিস্ট দুনিয়ায় সন্দেহ বাতিকটা যে একটু বেশি প্রবল, তা চেকোস্লোভাকিয়ায় কূটনীতিক হিসেবে কাজ করার সময় থেকেই জানতাম৷ চেকরাও তখন কমিউনিস্ট, সেই সঙ্গে স্লোভাকরাও, তবে ব্রাতিস্লাভা না গেলে তাদের দেখা পাওয়া যেত না....যাই হোক, প্রাগ-এই শুনেছিলাম, যদি কট্টর কমিউনিস্ট কোথাও পাওয়া যায়, তবে পূর্ব জার্মানিতে৷ বলতে কি, ভোপো-র পুলিশ ট্রেনে উঠে পশ্চিম থেকে আসা প্রতিটি যাত্রীর কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখছিল৷ আমি আবার ভারতীয়, সাথে ভারতীয় পাসপোর্ট৷ কাজেই মানিব্যাগ খুলে দেখাতে হল, তা-তে কী আছে: প্রতিটি নোট, প্রতিটি কাগজ৷
বাইরে তখন কয়শোজ-গুলোর বিরাট বিরাট দিগন্তবিস্তারী গম কিংবা অন্য কোনো ফসলের খেত৷ মাঝেমধ্যে পুরনো রেলপুলের তলায় এক ঝলক ধুলিধূসরিত, বা কালিঝুলি মাখা কোনো গ্রাম; বাড়িগুলো যেন দু-দু'টো বিশ্বযুদ্ধ সবে সামলে উঠেছে, এখনো ঘা শুকোয়নি৷ এমন মলিন, বিষণ্ণ জনপদ যে থাকতে পারে – তা-ও আবার একটা দেশে যার নামের মধ্যে জার্মানি রয়েছে, এ আমাকে বললেও বিশ্বাস করতাম না৷ পরে যখন ওয়ারশ পৌঁছানোর আগে দেখলাম খেতের কালো মাটি খুঁড়ে আলু তোলা হচ্ছে, পাশে ধুনি জ্বলছে, তখন বুঝলাম, ইউরোপ আসলে একটি নয়, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবির বিভিন্ন সিন কিংবা দৃশ্য৷ আপনি যে কোন শতাব্দীতে এসে পড়েছেন, এখানে সেটা বলে দিতে হয়৷
সেই পূর্ব জার্মানিতে পরে বহুবার গেছি: বড়মেয়ে পড়ত লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে; পরে তো সেখানেই তার প্র্যাকটিস৷ বার্লিনে তো গেছিই, যদিও বার্লিনের কাণ্ডকারখানাই আলাদা, ঠিক সাবেক লর্ড মেয়র ভোভেরাইট যেমন বলেছিলেন: বার্লিন গরিব হলেও ‘সেক্সি'৷ আর বাকি পূর্ব জার্মানি, থুড়ি, সাবেক পূর্ব জার্মানি? একবার নয়, বেশ কয়েকবার যানজটে পড়ে মোটরওয়ে ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে গেছি; প্রতিবারেই অবাক হয়েছি, জার্মানরা কিভাবে তাঁদের দেশটাকে বদলে ফেলে; এখানে দেশ পুরনো হয় না, শুধু নতুন হয়৷ পূর্ব বার্লিনের – থুড়ি, বার্লিনের পূর্বাংশে – ফ্রিডরিশহাইনে একটির পরে একটি রাস্তার বাড়িগুলোকে সারিয়ে, চুনকাম করে নতুন করে ফেলা হচ্ছে৷ কমিউনিজমের সেই কালো পর্দা আর ধোঁয়াশাটা যেন ধীরে ধীরে ঘষে তুলে ফেলে অন্ধকারে আলো আনা হচ্ছে৷