ইসলামিক নারীবাদ কী?
৪ মার্চ ২০২০অনেকের জন্যই ‘ইসলামিক নারীবাদী' শব্দগুলো বিপরীতার্থক৷ কিন্তু ১৯৯০ সালে যখন ইরানি ‘অ্যাক্টিভিস্ট' জিবা মির-হোসেইনি এই উপাধিটি চালু করেন, তখন এটি মূলত ছিল নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ তৈরির জন্য৷
যেহেতু জিবার স্বামী বিষয়টি মেনে নিচ্ছিলেন না, জিবা তাঁর স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্সও চাইছিলেন৷ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী আইন নিয়ে পড়াশোনা করার পর তিনি ইসলামের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে দেখছিলেন কোন কোন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে স্বামীকে ডিভোর্স দেয়া যায়৷ কারণ, ইসলামিক আইনে পরিচালিত বেশিরভাগ দেশে কাজটি কঠিন৷
মাসের পর মাস আদালতে ধর্ণা দিয়ে অবশেষে তিনি স্বামীকে ডিভোর্স দিতে সক্ষম হন৷ তিনি এরপর যুক্তরাজ্যে ফিরে আসেন এবং ইসলামিক পারিবারিক আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন৷ সেই থেকে তিনি ধর্মীয় নীতি ও আধুনিক জীবন বাস্তবতার সংঘাতের জায়গাগুলোর আইনগত দিকগুলো নিয়ে কাজ করাকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়েছেন৷
২০০৯ সালে ইসলামিক নারীবাদ নিয়ে মালয়শিয়ায় একটি সম্মেলন হয়৷ ৫০টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে চলা এই সম্মেলনটি একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়৷ সম্মেলনটির আয়োজক ছিল ‘মুসাওয়াহ' বা সমতা নামের একটি আন্দোলন৷ এরা নিজেদের ‘মুসলিম পরিবারে সমতা ও ন্যায়ের বৈশ্বিক আন্দোলন' নামে পরিচয় দেয়৷
বিভিন্ন আরব দেশ এবং ইরানেও এই আন্দোলন বেশ গতি পেয়েছে৷ তারা জাতিসংঘ নারী বা ‘ইউএন উইমেন'-এর সঙ্গে মিলে ধর্মীয় কাঠামো নিয়ে গবেষণা করছে এবং ধর্মের নামে নারীদের ওপর যেসব বৈষম্যমূলক আচরণ করে তা বন্ধে কাজ করছে৷ যেমন, নারীর যৌনাঙ্গচ্ছেদ বা এফজিএম৷
সব চিন্তাধারার নারীবাদীরা একসঙ্গে
মিশরে ইসলামী নারীবাদের ধারণা খুব বেশি বিস্তৃত নয়৷ অল্প কিছু গবেষক ও কর্মী এ নিয়ে কাজ করছেন, তাও খুবই সীমাবদ্ধ পরিসরে৷ ইংরেজির অধ্যাপক উমাইমা আবু বকর মিশরে এই ধারণার একজন প্রবর্তক৷ তিনি বলেন, ‘‘মিশরে ইসলামী নারীবাদের ধারণা আদর্শিক ও তাত্ত্বিক পর্যায়ের৷ তারা মুসলিম গবেষক ও ইসলাম বিশ্লেষকরা ধর্মের ঐতিহ্যগত পুরুষতান্ত্রিকতার সমালোচনা করা এবং আর সমতাভিত্তিক বিকল্প তৈরির সম্ভাব্যতা নিয়ে কাজ করেন৷ এই প্রকল্প স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে বিভক্ত৷''
মিশরে ইসলামী নারীবাদ এখনো ব্যক্তিগত পর্যায়েই কাজ করছে বলে জানান উমাইমা৷ তবে ‘দ্য উইমেন অ্যান্ড মেমরি ফোরাম' নামের একটি সংগঠনও কাজ করছে বলে জানান তিনি৷
উমাইমা জানান তাঁরা মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলে কাজ করেন৷ তবে কিছু মৌলিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে দ্বিমতও রয়েছে তাদের৷ যেমন, নারীর অভিভাবকত্ব, বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে৷
আলেকজান্দ্রিয়া ঘোষণা: নারীবাদের মাইলফলক
মিশরের শহর আলেকজান্দ্রিয়ার সংস্কৃতি কেন্দ্র ও লাইব্রেরি বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ২০১৪ সালে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়৷ সেখানে নারী অধিকারের কয়েকটি মৌলিক বিষয় তুলে ধরা হয়৷ বিশেষ করে নারী ইস্যুগুলোর রাজনীতিকরণ এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংকটে তার অপব্যবহার৷
তারা কট্টরপন্থা বা একেবারে বিচ্ছিন্নতা থেকে সরে গিয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে৷
সমাজে নারী পুরুষের সমান অধিকারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নারীকে আরো বেশি সামাজিক স্তরে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়৷ তারা দু'পক্ষের অংশীদারিত্বের কথা বলে৷
অভিভাবকত্ব নিয়ে ঘোষণায় বলা হয়, অনেক পুরুষ অভিভাবকত্বের সুযোগ নিয়ে পরিবারে স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে৷ ঘোষণায় তাদের অভিভাবকত্বকে অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়৷ অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তানদের চাহিদা মেটাবার জন্য যে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন, সে দায়িত্ব পালন করবেন পুরুষ৷
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘‘অভিভাবকত্ব মানে এই নয় যে, পুরুষ যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বা কাজ করতে পারেন এবং স্ত্রী ও সন্তানের ওপর কর্তৃত্ব দেখাতে পারেন৷'' ঘোষণায় নারী ও পুরুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমতা বিধানের কথাও বলা হয়৷
সমালোচনার মুখে ইসলামী নারীবাদ
বিষয়টি নতুন হলেও ইসলামীও নারীবাদ সমালোচনার উর্ধ্বে নয়৷ অনেকেই মনে করেন ইসলামে পুরুষের কর্তৃত্ব অনেক৷ তাহলে এখানে নারীবাদের সুযোগ কোথায়?
উমাইমা বলেন, ‘‘নারীবাদের এমন সংজ্ঞা খুবই অগভীর এবং উদার নারীবাদেই সীমাবদ্ধ৷ অথচ বাস্তবতা হল, অনেক রকমের নারীবাদ রয়েছে যেমন, বামপন্থি নারীবাদ কিংবা খ্রিস্টান ও ইহুদী নারীবাদ আন্দোলন৷''
তিনি যোগ করেন, ‘‘নারীবাদের যেসব আন্দোলন ধর্মীয় গণ্ডিতে হচ্ছে, সেগুলো নতুন কিছু নয় এবং নারীবাদ কেবল উদারপন্থি ভাবনা নয়, এটা বিচিত্র ও সূক্ষ্ম৷''
ইসলামী নারীবাদের আরেকটি সমালোচনা হল, এটি মুসলিম ব্রাদারহুডের সমান্তরাল আদর্শ কি না৷ উমাইমা বলেন, আসলে ইসলামী নারীবাদ দু'তরফ থেকেই আক্রান্ত৷ যারা উদারপন্থি তারা শুধু নিজেদের স্বার্থেই একে ব্যবহার করতে চাইছেন৷ অন্যদিকে, কট্টরপন্থিরা একে বেশি উদার মনে করেন৷
তিনি মনে করেন, এই দুইয়ের মাঝে পড়ে মুসলিম নারীদের কণ্ঠস্বর শুনতেই যেন পান না কেউ৷
সালমা খাতাব/জেডএ
২০১৭ সালের এই ছবিঘরটি দেখুন: