‘ইভ টিজিং’ প্রতিরোধে মেয়েদের বিশেষ প্রশিক্ষণ
২৪ জুন ২০১০ঋতিকা মোহন, ১৮ বছরের তরুণী৷ থাকেন দিল্লিতে৷ এক মাস আগের ঘটনা, ঋতিকা রাস্তায় হাঁটছিলেন৷ একটি মোটরবাইক হঠাৎ তার পাশে ঘেঁষে আসে৷ আরোহী লোকটি জোর-জবরদস্তি করে ঋতিকাকে তার বাইকে ওঠাতে চায়৷ কেঁদে কেটে একসারা হয়েছিলেন ঋতিকা৷ অনেক কষ্টে বেঁচেছিলেন ওই লম্পটের কবল থেকে৷ তবে এখন সে ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হলে দেখা যাবে অন্য ঋতিকাকে৷ তিনি বলেন, এখন আর আমি ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নই৷ কেউ এমন করলে তাকে লাথি হোক, ঘুষি হোক, কিছু একটা খেয়েই যেতে হবে৷
ঋতিকার মতো অনেক তরুণীকেই এই সাহস যুগিয়েছে কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র৷ পথেঘাটে ইভ টিজিং কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেখানে তাই শেখানো হয় নারী বিশেষ করে তরুণীদের৷ সরকারির পাশাপাশি এ ধরনের বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে ভুরি ভুরি৷ দিল্লির এমনই একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন ঋতিকা৷ তার সঙ্গী মা ও ছোট দুই বোনও৷ তাদের শেখানো হয়, অভদ্র আচরণ করলে কাউকে রেহাই দেওয়া যাবে না৷
ভারতের ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য, ২০০৮ সালে নারীর প্রতি সহিংস ঘটনা ঘটেছে ২ লাখ৷ তবে প্রকৃত সংখ্যা যে এর অনেক বেশি, তা সবাই মানছেন৷ কারণ বাসে-ট্রামে আর পথে ইভ টিজিংয়ের যে ঘটনাগুলো ঘটে, তা নিয়ে তো আর পারতপক্ষে কেউ থানায় যায় না৷ ফলে সেগুলো থেকে যায় অগোচরেই৷ ভুক্তভোগীরা বলছেন, অতিষ্ঠ হয়ে তারা এখন আত্মরক্ষার কৌশল শিখছেন৷
দিল্লির সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র জাগরীর যাত্রা শুরু হয় ২০০২ সালে৷ প্রশিক্ষক রাধা শর্মা সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানালেন, এ পর্যন্ত ৭০ হাজার নারী সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন৷ এর মধ্যে গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুলছাত্রীরাও রয়েছে৷ প্রশিক্ষণের জন্য টাকা নেওয়া হলেও গরমের ছুটির সময় স্কুলগুলোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বিনা টাকায়৷
শাড়ি কিংবা সালোয়ার-কামিজ, কেউ যে পোশাক পরেই থাকুন না কেন, তাতেই কীভাবে পাল্টা আক্রমণ করা যায়, তাই শেখানো হয় কেন্দ্রগুলোতে৷ দেখানো হয়, ব্যবহারে দোপাট্টা বা ওড়নাই হয়ে উঠতে পারে আত্মরক্ষার ভালো অস্ত্র৷ বিষয়টি এমন, ওড়না দিয়ে আক্রমণকারীর গলা পেঁচিয়ে ফেলো, তারপর মারো টান নিচের দিকে৷ আক্রমণকারী তখন ধুলোয় লুটোপুটি খাবে৷ আর লাথি-গুঁতো, ঘুষি তো রয়েছেই৷ সঙ্গের কলম বা চুলের কাঁটাটি আক্রমণকারীর গায়ে বিঁধিয়ে দিয়ে আত্মরক্ষার কৌশলও শেখানো হয়৷
ইভ টিজিং কিংবা রাস্তায় কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যে পড়লে কোনোভাবেই নীরব না থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন রাধা৷ তার ভাষায়, ‘‘জেগে ওঠো নারী৷ কথা বলো উচ্চকণ্ঠে৷ তৈরি হও যে কোনো আঘাতের জবাব দিতে৷''
মুম্বাইয়ে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাচ্ছেন নন্দা দয়াল৷ তার ছাত্রী ১৫ জন৷ ছয় দিনের একটি কোর্সের জন্য তিনি ৩ হাজার রুপি করে নেন৷ একই ধরনের চিত্র দেখা গেলো কলকাতায়ও৷ সেখানে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা রামমোহন রায়৷ তাঁর এ কাজ শুরুর পেছনেও একটি ঘটনা আছে৷ তা হলো, তাঁর স্কুলছাত্রী মেয়েকে যৌন হয়রানি করেছিলো এক শিক্ষক৷ তারপরই তাঁর এ কাজে নামা৷
রামমোহন বলেন, ‘‘আসলে ভারতীয় নারীদের সবকিছু মেনে নেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু আছে, সেটা আসলে খুবই খারাপ৷ দৈহিকভাবে তো তারা শক্তিহীনা নয়, অথচ এ বিষয়ে তারা অসচেতন৷''
তবে নারীর এ সমস্যা সমাধান শুধু আত্মরক্ষার কৌশল চর্চা করে হবে বলে মনে করছেন না সমাজ গবেষকরা৷ তারা বলছেন, নারীর প্রতি পুরুষদের মনোভাব বদলানোটা জরুরি৷ যেমন বলছিলেন জাগরীর গবেষক কল্পনা বিশ্বনাথ৷ তিনি বলেন, ‘‘আত্মরক্ষার কৌশল একটা টোটকা হতে পারে৷ আসলে যা প্রয়োজন, তাহলো পুরুষদের শিক্ষা নেওয়া৷ তারা নারীর সঙ্গে কেমন আচরণ করবে৷''
প্রতিবেদন: মনিরুল ইসলাম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক