ইন্টারনেট আসক্তি
৯ জুলাই ২০১২ক্লাউস ইন্টারনেটে দারুণ আসক্ত এক ব্যক্তি৷ এই আসক্তি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে ওঠে যে, এক সময় তাঁর যেন নিজস্ব অস্তিত্ব হারিয়ে যায়, একাকার হয়ে যায় ইন্টারনেটের সঙ্গে৷ ৯০ এর দশকের শেষ দিকে প্রথম ইন্টারনেটের সংস্পর্শে আসেন ক্লাউস৷ ইমেইল ঠিকানা খোলেন, চ্যাট ও সার্ফিং এর সঙ্গে হয় হাতেখড়ি৷ সে সময় অবশ্য ব্যাপারটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল৷ প্রতিদিনের কোনো বিষয় ছিল না৷ ক্লাউস জানান, ‘‘ইন্টারনেটের ফাইনাল ফ্যান্টাসির মত ভার্চুয়াল গেমগুলি আমাকে নেশার জগতে নিয়ে আসে৷ এইসব খেলায় একবার ডুবে গেলে আমি সময় ও জগৎসংসার একেবারে ভুলে যেতাম৷''
বাস্তব জগতের সঙ্গে দূরত্ব
ক্লাউস বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের অবহেলা করা শুরু করলেন৷ এমনকি ঘুম ও নাওয়া খাওয়ার কথাও মনে থাকতো না তাঁর৷ রাতগুলি কেটে যেত ইন্টারনেটের জগতে৷ ঘুম থেকে উঠলেই চুম্বকের মতো টানতো তাঁকে ইন্টারনেট৷
জার্মান সরকারের নেশাসম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানা গেছে, ইন্টারনেটের নেশা ক্লাউসের একার সমস্যা নয়৷ এই নেশা এক সামাজিক সমস্যা৷ জার্মানির ১৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে ৫ লক্ষ ৬০ হাজার ইন্টারনেটে আসক্ত৷ এছাড়া ২৫ লক্ষ জনের মধ্যে ইন্টারনেটের কারণে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে৷
মাদকাসক্তদের মত লক্ষণ
মদ ও হিরোইন আসক্তদের মত লক্ষণ দেখা দেয় ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলদের৷ জানান মানসিক রোগের চিকিত্সা ও থেরাপি কেন্দ্র, রাইন ইউরা ক্লিনিকের প্রধান চিকিত্সক ডা. মিখাইল বেন্ডার৷ ইন্টারনেটের নেশা থেকে মুক্ত করতে চাইলে তারা মাদকাসক্তদের মতই যন্ত্রণা অনুভব করেন৷ ডা. বেন্ডার জানান, ‘‘অনেকেই লক্ষ করেন যে, তারা সামাজিক কাজকর্ম ও অবসর সময়ে অন্য কিছু করা থেকে বিরত থাকছেন৷ কিন্তু এসব বুঝেও ইন্টারনেটের নেশা থেকে বের হতে পারেন না তারা৷ হারিয়ে ফেলেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ৷''
হানোফার শহরের শিশু হাসপাতালের মানসিক বিভাগের চিকিত্সক ক্রিস্টফ মোলার বলেন, ‘‘অতিরিক্ত মাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই যে, কেউ তাতে আসক্ত একথা বলা যায় না৷ সমস্যাটা হয় তখনই, যখন কারো ক্ষতি হয়, যেমন স্কুল যাওয়া বা সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়৷''
ডিপ্রেশন, ভীতি ইত্যাদি মানসিক সমস্যা থেকেও অনেকে ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে পড়েন৷ বাস্তব জীবনে সমস্যা হলে কল্পলোকে স্বান্ত্বনা খোঁজেন তারা৷ মন মেজাজ ভাল না থাকলেও ইন্টারনেট দিয়ে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়৷
অল্পবয়সী ও ছেলেদের ঝুঁকি বেশি
অল্পয়সী অর্থাৎ ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যেই ইন্টারনেটে ডুবে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়৷ আনুমানিক ২ লাখ ৫০ হাজার তরুণ তরুণী ইন্টারনেটে আসক্ত৷ বিশেষ করে অনলাইন গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা৷
অল্পবয়সীদের মধ্যে আবার ছেলেরাই ইন্টারনেটের আবর্তে পড়েন বেশি৷ তবে ফেসবুক, চ্যাটিং ইত্যাদির মত সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে আছে৷
ক্রিশ্টফ মোলার জানান, এ ক্ষেত্রে উদ্বেগ জাগানোর মত ঘটনাও ঘটে৷ ইন্টারনেটের ঘেরাটোপে পড়ে অনেক মা এমনকি নিজের সন্তানদেরও অবহেলা করতে থাকেন৷ তাই বলা যায় প্রযুক্তির এই মাধ্যমটি শুধু মাত্র পুরুষদেরই সমস্যা নয়৷
রোগ হিসাবে এখনও স্বীকৃতি পায়নি
ডা. মোলার বলেন, ‘‘চিকিত্সা জগতে ইন্টারনেটের নেশাকে এখন পর্যন্ত আলাদা রোগ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি৷ আমরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছি৷'' ২০০৮ সালে মাইন্স ইউনিভার্সিটির মানসিক ক্লিনিকে ইন্টারনেট আসক্তদের জন্য জার্মানির প্রথম বহির্বিভাগীয় চিকিত্সা কেন্দ্র খোলা হয়৷ ইতিমধ্যে অন্যান্য শহরেও এই ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে৷ থেরাপিতে ইন্টারনেটের সঙ্গে একটা সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে শেখানো হয় রোগীদের৷ এছাড়া নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন করে তোলা হয়৷ প্রণোদিত করা হয় অন্য কোনো শখের বিষয় খুঁজে নিতে৷ থেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে কর্মজীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আসক্তদের৷
মিশাইল বেন্ডারের মতে, ভুক্তভোগীদের অবস্থা অবশ্য সরু সুতায় ঝোলার মত৷ অর্থাৎ সুস্থ হলেও একটুতেই কাত হয়ে পড়তে পারেন তারা৷ কেননা একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেউ পেশাগত বা ব্যক্তিগত কোনো দিক দিয়েই ইন্টারনেটকে এড়িয়ে চলতে পারে না৷
ক্রিশ্টোফ মোলার জোর দিয়ে বলেন, মা বাবার উচিত, বাচ্চাদের ঘর টিভি বা কম্পিউটারের স্ক্রিনমুক্ত রাখা৷ কেননা ছোটদের শারীরিক ও মানসিক বর্ধনের জন্য প্রয়োজন আবেগ অনুভূতির জাগরণ, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘তবে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও সব সময় ইতিবাচক আদর্শ স্থাপন করতে পারেন না৷ আজ অপেরা বা এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই, যেখানে অনুষ্ঠান চলাকালে মোবাইল ফোন বেজে না ওঠে৷''
প্রতিবেদন: আর্নে লিখটেনব্যার্গ / আরবি
সম্পাদনা: জাহিদুল হক