1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইটালি ও ব্রাজিলের পর জার্মানি?

পবিত্র কুন্ডু
৮ জুন ২০১৮

রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে লিখতে গিয়েও মনে পড়ে যাচ্ছে আগের আসরে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে জার্মানির চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ের স্মৃতি৷ আরো বেশি করে হানা দিচ্ছে জার্মানির কাছে ব্রাজিলের ৭-১ গোলে হারের লজ্জা, অপমান এবং কান্না৷

https://p.dw.com/p/2z8HD
বিশ্বকাপগামী জার্মান ফুটবল দলের আনুষ্ঠানিক ছবিছবি: picture-alliance/GES/augenklick/M. Gilliar

এক এক করে বল ঢুকছে ব্রাজিলের জালে, গোলকিপার জুলিও সিজার বল কুড়িয়ে আনতে আনতে ক্লান্ত৷ বলের বাঁক বুঝতে ভুল করে পড়ে গেলেন, হলো সাত নম্বর গোল৷ সিজার পড়েই রইলেন মাটিতে৷ ডেভিড লুইসের দু'চোখে তখন শ্রাবণধারা৷ গ্যালারির হলুদ সর্ষে ক্ষেত অকস্মাৎ ঝড়ে লন্ডভণ্ড৷ জার্মানির জয়োৎসবের পাশে ব্রাজিলের এই কান্নার ছবি কোনোদিনই মুছে যাওয়ার নয়৷

আর ঠিক এই ছবিটা যখন চোখে ভাসে, আমি চলে যাই প্রায় দুই যুগ পেছনে, যেখানে আমার সামনে বসে থাকেন বাংলাদেশের সাবেক জার্মান ফুটবল কোচ অটো ফিস্টার, যিনি বলেছিলেন, জার্মান ফুটবলের আলাদা একটা ধারা আছে ঠিকই, কিন্তু জার্মানরা ব্রাজিল ফুটবলেরই সৌন্দর্য পিয়াসী৷ ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ-জার্মানি সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তিতে বাংলাদেশে কাজ করতে এসেছেন অটো ফিস্টার৷ ‘হাইপ্রোফাইল’ কোচ৷ তাঁকে বলা হয় ঘানার আধুনিক ফুটবলের জনক৷ আমার সংবাদিক-সত্তা ভবিষ্যতে অনেক লেখালেখির খোরাকের জন্য ফিস্টারের ঘনিষ্ঠতা দাবি করেছিল৷ সে জন্যই বলেছিলাম, ‘‘আমি জার্মান ফুটবলের খুব ভক্ত৷ যে যা-ই বলুক, হার না মানা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কীভাবে জিততে হয়, এটি শেখার জন্য জার্মানির চেয়ে আদর্শ দল আর হয় না৷’’ আমার চোখে ফিস্টারের চোখ৷ মুখে মৃদু হাসি৷ ওপরচালাকিটা ধরে ফেলেছেন৷ যা উচ্চারণ করলেন তাতে ব্রাজিল ফুটবলের জন্য তাঁর শ্রদ্ধার ফুলগুলো চিরসজীব, ‘‘পাপা, আমি ভালোবাসি ব্রাজিলের ফুটবল৷ শুধু আমিই নই, বেশির ভাগ জার্মানই৷ কোনো একদিন আমরা ব্রাজিলের মতো খেলতে পারবো, সেই স্বপ্ন আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়৷’’

কোরিয়া- জাপান ২০০২ বিশ্বকাপে পাশাপাশি বসে কাজ করার সুবাদে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল জার্মান সাংবাদিক ভিলহেমের সঙ্গে৷ ব্রাজিল-জার্মানি ফাইনাল আর ভিলহেম কিনা পড়ে আছে ফিস্টার-দর্শন নিয়ে, ‘‘বন্ধু, জার্মানি ফুটবল খেলে অল্পবিস্তর সাফল্য পেয়েছে ঠিক আছে৷ তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন (তখন পর্যন্ত) হওয়াটা কম কথা নয়৷ তবে আসল কথা হলো, জার্মানি ব্রাজিলের মতো ফুটবলটা এখনো খেলে স্বপ্নে!’’      

বছরের আট মাস তীব্র শীত৷ তুষারে ঢাকা জনপদে সুন্দর ফুটবল কী করে হবে? ব্রাজিলের মতো বড় বড় সৈকতের বালুকাবেলা কোথায় পাবে জার্মান কিশোর-তরুণেরা? ফুটবল যে ব্রাজিলের মতো জার্মান সংস্কৃতির রক্তকণিকায় ঢোকেনি৷ ভিলহেমের ব্যাখ্যাটা মেনে নিয়েছিলাম, তবে দ্বিধাহীনভাবে নয়৷ ফুটবলের সৌন্দর্য বুঝি না তা নয়, কিন্তু জয়-পরাজয় যেখানে সাফল্যের মানদণ্ড, সেখানে জার্মানিকে কুর্নিশ করতেই হয়৷

তাহলে মিনেইরাওতে ২৯ মিনিটে ব্রাজিলকে পাঁচ গোল দিয়ে ফেলার পর জার্মানি আর বেশি গোলের জন্য ঝাঁপায়নি ওই শ্রদ্ধাবোধ থেকেই! যে ফুটবল এতদিন শ্রদ্ধার বেদিতে থেকে হৃদয়ের অর্ঘ্য পেয়ে এসেছে, সেই ফুটবলকে লাম-ম্যুলার-ক্রুস-ও্যজিলরা আর বেশি অসম্মান করতে চাননি! অন্তত গোটা দশেক গোল না হওয়ার এটি একটি ব্যাখ্যা হতে পারে৷

সত্যি করে বললে জার্মান ফুটবলই এখন আলাদা শ্রদ্ধার বেদিতে বসেছে৷ সেই ফলকেন্দ্রিক বিরক্তিকর ফুটবল জার্মানদের পা থেকে বিদায় নিয়েছে৷ এখন তারাও সবুজ আয়তক্ষেত্রে পাসের ফুল ফোটায়৷ আক্রমণ ও পালটা আক্রমণকে শিল্পের সুষমায় ভরিয়ে দেওয়ার ব্রত নিয়ে এগোচ্ছে জার্মান দল৷ মিনেইরাওয়ের ওই সাত গোলে জার্মানি বিশ্বকাপে গোলের সংখ্যায় ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে শীর্ষে৷ সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিক করেছে কোন দল? উত্তর: জার্মানি৷ ২০১৪ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পাস খেলেছে কোন দল? এ ক্ষেত্রেও উত্তর– জার্মানি৷

গ্যারি লিনেকার একদা বলেছিলেন, ‘‘ফুটবল খুব সহজ খেলা, ২২ জন খেলোয়াড় একটি বলের পেছনে ছোটে আর খেলা শেষে জয়ী হয় জার্মানি৷’’ সরাসরি না বলে সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকার যে জার্মানির ফুটবলকে কদর্য-কুৎসিত ফল-নির্ভর বিরক্তিকর বলে কটাক্ষ করেছেন, সেটি সবাই বোঝে৷ কে জানে এখন লিনেকারের চোখেই মুগ্ধতা ছড়ায় কি না জার্মানির ফুটবল!

কীভাবে বদলে গেল জার্মানির ফুটবল? উত্তরটা দেওয়া উচিত ইওয়াখিম ল্যোভ-এর, কেননা, এক দশক ধরে জার্মানির ফুটবলে সত্যিকারের বিপ্লব এনেছেন তো তিনিই৷ একদা ‘মিসফিট’ এই ম্যানেজারই এখন জার্মান ফুটবলের সফলতম ম্যানেজার৷ তাঁর অধীনে এক গুচ্ছ তরুণ মাঝমাঠে পাসের ঠাসবুননে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে দিতে পারে৷ তারা জিততে পারে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নির্দয় পাল্টা আক্রমণ হেনে৷ মিনেইরাওয়ের ওই ইতিহাস বিধৃত সেমিফাইনালের কথা বাদ দিন, দ্বিতীয় সারির অনভিজ্ঞ তরুণ একটি দল নিয়েও যে জার্মানি জিততে পারে, সেটির প্রামাণ্য গত বছরের কনফেডারেশনস কাপ৷

জার্মান পেশাদার লিগ বুন্ডেসলিগা এখন টিভি সম্প্রচারকারীদের কাছে স্বপ্নের আয়োজন৷ স্টেডিয়ামগুলো দর্শকে টইটম্বুর৷ নৈপুণ্যভাস্বর খেলোয়াড় উঠে আসছে স্রোতের মতো৷ জার্মান ফুটবলের গভীরতা এখন এতটাই যে, এই বিশ্বকাপে ২৩ জনের অন্তত দু'টি দল দিতে পারতো জার্মানি৷

Pabitra Kundu
পবিত্র কুন্ডু, ক্রীড়া সাংবাদিকছবি: privat

‘‘তারা আমাকে রক্ষণে এসে বল কাড়তে বলেন, বলেন মাঝমাঠের দখল রাখতে, এমনকি ফাইনাল থার্ডে গিয়ে নিজেই নিজেকে পাস দিয়ে গোল করতে বলেন’’— কথাটা মিশায়েল বালাকের৷ বলেছিলেন ২০০২ বিশ্বকাপের পর৷ একেবারেই একটা সাদামাটা দল নিয়ে শুধু মাঝমাঠে বালাকের কারিশমা আর গোলে অলিভার কানের বিশ্বস্ত ও সাহসী দুটি হাত সম্বল করে ওই বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল জার্মানি৷ আদতে তখন ‘ডি মানশাফট’-এর অন্ধকার যুগ চলছে৷ সৃষ্টিশীল নবীন কোনো খেলোয়াড় নেই— বয়সি খেলোয়াড়দের নিয়ে বিশ্বসেরা মঞ্চে কোনোক্রমে দিন কাটাচ্ছিল জার্মানি৷ এভাবে জার্মান ফুটবলসাম্রাজ্য চলতে পারতো না৷ তখনই আবির্ভাব ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান আর ল্যোভ-এর৷ ক্লিন্সমান সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিকল্পনা আঁকেন আর সেটি জার্মানিতে বসে বাস্তবায়ন করেন ইয়াওখিম ল্যোভ৷ ঘরের মাঠের ২০০৬ বিশ্বকাপেই সাফল্যের ফুল ফুটতে চলেছিল, ফুটতে পারলো না সেমিফাইনালে বিশ্বকাপের ইতিহাসেরই অসাধারণ এক ম্যাচে ইটালির কাছে হেরে৷

একদিক দিয়ে খারাপ হয়নি৷ সোনা পুড়ে পুড়ে যেমন খাঁটি হয়, তেমনি করেই পরিণত হয়ে উঠেছে জার্মান ফুটবল৷ তাই বলা হচ্ছে, ইটালি ও ব্রাজিলের পর জার্মানিই সেই দল যারা এবার ধরে রাখতে পারে বিশ্বকাপ শিরোপা৷ ইটালি পর পর বিশ্বকাপ জিতেছিল আদি যুগে— ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে৷ আর ব্রাজিল জিতেছিল ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে৷ ফুটবল এখন পেশাদারির কঠিন-কঠোর বর্মে আবৃত৷ ফুটবল আর বিজ্ঞান এখন একাকার৷ এই সময়ে জার্মানির টানা দুবার বিশ্বকাপ জয়ের মহিমাই হবে অন্যরকম৷

রাশিয়া বিশ্বকাপ যত কাছে চলে আসছে, জার্মানিকে নিয়ে এই বিশ্বাসটা আমার মধ্যে কেন জানি না ডালপালা মেলছে৷ দেখতে পাচ্ছি, ডাগআউটে কালো ট্রাউজারের ওপর সাদা শার্টের একটি দীর্ঘ শরীর অবিচলিত বসে থেকে হঠাৎ হঠাৎ জয়োদ্ধত একটি মুষ্টি ছুড়ছেন বাতাসে৷ ইওয়াখিম ল্যোভ!