‘ইটালিয়ানরা আমাদের দেখলেই বলে ভাইরাস’
১৬ জুলাই ২০২০চীনের পর করোনার সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রমণটি ঘটে ইটালিতে৷ প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় ভাইরাসটি৷ আক্রান্ত হন দুই লাখ ৪৩ হাজারের বেশি৷ তবে ইরোপের অন্য দেশগুলোর মতোই ইটালিও এই পরিস্থিতিকে এখন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে৷ খুলছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দুয়ার৷ জুনের পর থেকে তাই বিশেষ ফ্লাইটে বাংলাদেশি প্রবাসীরাও ফিরতে শুরু করেছিলেন তাদের কর্মস্থলে৷ কিন্তু তাদের মাধ্যমে দেশটিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে নতুন করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে৷ এ কারণে গোটা ইটালিতেই বাংলাদেশিরা সংবাদ শিরোনাম আর আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হন৷
পাভেল রহমান বহু বছর ধরেই ইটালির রোমে বসবাস করছেন৷ তিনি জানান, লকডাউনের সময় বাংলাদেশিরা এখানে তেমন একটা আক্রান্ত হননি৷ কিন্তু এখন পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে৷ ‘‘আগে আমরা ইটালিয়ানদের দেখে এড়িয়ে চলতাম৷ এখন তারা আমাদের এড়িয়ে চলে,’’ বলেন তিনি৷
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশিরা অনেকে দেশ থেকে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরেছেন, যা সঠিক ছিল না৷ অনেকেই ফেরার পর কোয়ারান্টিনের নিয়ম মানেননি, যার কারণে এতটা সমালোচিত হচ্ছেন বাংলাদেশিরা৷ ভেনিসে বসবাসরত নীপা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চার-পাঁচ মাস ঘরে বন্দি ছিলাম৷ পরিস্থিতির এখন অনেকটা উত্তরণ হয়েছে৷ কিন্তু ভুয়া সার্টিফিকেট নিয়ে যারা এসেছে তাদের কারণে ইটালিতে আমরা বাঙালিরা এখন খুবই লজ্জায় রয়েছি৷’’
ভেনিসে বাংলা ভাষার একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল সৈয়দ কামরুল সরোয়ার৷ তিনিও একই অভিজ্ঞতার কথা জানান৷ ‘‘৩০ বছর ধরে আমি এখানে আছি৷ কিন্তু আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিটির অবস্থা শোচনীয়৷ ...ইটালিয়ানদের কাছে আমরা অনেক হেয় হয়েছি,’’ বলেন সরোয়ার৷
ভেনিসে প্রবাসীদের মধ্যে সফল একজন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী৷ তিনি সেখানে বাংলাদেশিদের একটি মসজিদেরও প্রধান৷ তিনি বলেন, ‘‘লকডাউনের পর আমরা বলতে গেলে এখন করোনা-মুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম৷ এখন পর্যটন আসা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক আসলো৷ তাদের অনেকেই কোয়ারান্টিন মানেনি ৷ আমাদের ভাবমূর্তি এখানে অনেক নষ্ট হয়ে গেছে৷’’
তিনি জানান, নিজেদর দক্ষতা আর সততা দিয়ে ইটালিতে বাংলাদেশিরা অনেক সুনাম অর্জন করেছিলেন৷ কিন্ত অল্প কয়েকজনের কারণে তা নষ্ট হয়ে গেছে৷ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘‘এখন ইটালিয়ানরা আমাদের দেখলেই বলে ভাইরাস৷ আমরা একটা হেরেজমেন্টের মধ্যে পড়ে গেছি৷’’
তার আশঙ্কা করোনার নেগেটিভ সার্টিফিকেটের জালিয়াতির কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে যে-কোনো সনদের ক্ষেত্রে ইটালি তথা ইউরোপে বিপাকে পড়তে হবে প্রবাসীদের৷
গোটা বিষয়টিতে শুধু ইমেজ সংকটেই পড়েছেন প্রবাসীরা তা নয়৷ কাজের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তারা৷ যখন সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, তখন অনেকেই তাদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারছেন না৷
‘‘ইটালির অনেক বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোতে বাংলাদেশিরা কাজ করেন৷ তাদের সঙ্গে এখন স্থানীয়রা কাজ করতে চাচ্ছেন না৷ তাদেরকে এখন বাসায় থাকতে হচ্ছে,’’ বলছিলেন পাভেল রহমান৷ রোমে বসবাসরত আরেক কাপড়ের ব্যবসায়ী আহসানও একই কথা বলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেকেরই কাজ নেই৷ কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েছিল৷ কিন্ত বাংলাদেশিরা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তারা আবার বিপাকে পড়ছেন৷’’
এই পরিস্থিতিতে নিজেদের কমিউনিটির সদস্যদের দায় যেমন দেখছেন, তেমনি দূতাবাস বা সরকারের কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব ছিল বলে মনে করেন প্রবাসীরা৷ বিশেষ করে যারা ফিরে এসেছিলেন তাদেরকে সচেতন করা, সেই সঙ্গে সঠিক তথ্য সরবরাহ করার কাজ ঠিকভাবে করা হয়নি৷ তবে সবার সঙ্গে মিলেই এখন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা৷ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আমরা বাঙালি কমিউনিটিরা বৈঠক করছি৷ আগামীতে কনস্যুলারদের ডেকে বড় আকারে বৈঠক করবো৷ পরবর্তীতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেই বিষয়ে আমরা কাজ করবো৷’’ তার মতে, ভুল স্বীকার করে সরকার থেকে যথাযথ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ইটালির সরকারের মধ্যে আস্থা ফেরে৷