জন্মহার কমছে, বাড়ছে প্রবীণরা
২৬ এপ্রিল ২০১৩ব্যাপারটা আসলে খুব সহজ৷ ইউরোপের একাধিক দেশে – যাদের মধ্যে জার্মানিও পড়ে – জনসংখ্যা হয় বাড়ছে না, কিংবা কমে যাচ্ছে৷ এর অর্থ, গড়ে শ্রমিকদের বয়স বাড়ছে, যার অর্থ, তাদের উৎপাদনশীলতা কমছে৷ অর্থনৈতিক বিচারে, এর ফলে সঞ্চয় কমবে, সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি কমবে৷
থাকছে পেনশনভোগীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা৷ ধরতে গেলে, জার্মানির একজন সাধারণ কর্মী তাঁর সমগ্র কর্মজীবনে পেনশন ফান্ডে যে পরিমাণ অনুদান দিয়ে থাকেন – এবং সেই সঙ্গে নিয়োগকারী সংস্থা কি প্রতিষ্ঠানের অনুদান – এই দু'টো যোগ করলেও পেনশন ফান্ডে একজন কর্মীর মোটামুটি এক বছরের মোট আয় জমা পড়ে৷ সে অর্থে অবশ্যই একজন অবসরপ্রাপ্তের সারা জীবনের পেনশন দেওয়া সম্ভব নয়৷ কাজেই পেনশন ফান্ডের ভালোমন্দ নির্ভর করে শ্রমবাজারে আরো কত নতুন কর্মী এলো এবং তাদের অনুদান দিতে শুরু করল, তার উপর৷
ভাগ্যাবানের বোঝা...
মুশকিল হয়, যখন পেনশনভোগীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, কিন্তু সেই পরিমাণে নতুন শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ে না৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশে আজ গড়ে চারজন নতুন শ্রমিক একজন পেনশনভোগীর বোঝা বহন করে৷ ২০৫০ সালে কিন্তু দু'জন করে শ্রমিককে একজন পেনশনভোগীর পেনশনের বোঝা বহন করতে হবে – যা এক কথায় অসম্ভব৷ অসম্ভব এ কারণেও বটে যে, জনসংখ্যার তরুণ বা কর্মক্ষম বা কর্মরত অংশ অবশ্যই এই অসম – এবং এক হিসাবে অন্যায় চাপ মেনে নেবে না৷ যার ফলে রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি হওয়াও আশ্চর্য নয়৷
বলাই বাহুল্য, পেনশনের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য, স্বাস্থ্য বীমার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য৷ অর্থাৎ পেনশনভোগীদের ভালো থাকা বা না থাকা যে দু'টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে, সেই পেনশনের পরিমাণ এবং হেল্থ কেয়ার বা স্বাস্থ্য সেবা, দু'টোই নির্ভর করছে ঐ ‘সামাজিক' কিংবা ‘প্রজন্মগত চুক্তির' উপর৷ যে চুক্তি ভঙ্গ হলে গোটা প্রণালীটা ভেঙে পড়তে বাধ্য৷
কে কা-কে দেখে
অথচ বিপদ তো ঠিক তাই৷ তার একটি চরম দৃষ্টান্ত হল লাটভিয়া, যেখানে ২০০০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে জনসংখ্যা কমেছে ১৪ পার্সেন্ট – হ্যাঁ, ১৪ শতাংশ৷ লাটভিয়া অতি ক্ষুদ্র দেশ, কাজেই সে দেশের জনসংখ্যা থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ কমে যাওয়াটা খুব কম কথা নয়৷ ওদিকে পেনশনের ক্ষেত্রে ২০৬০ সালে লাটভিয়ার প্রত্যেক চারজন শ্রমিকের জন্য থাকবে তিনজন পেনশনভোগী কিংবা ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষ৷
লাটভিয়ার এই দুর্দশার জন্য শুধু নিম্ন জন্মহারই নয়, অভিবাসনও দায়ী, অর্থাৎ নেতিবাচক অভিবাসন৷ লাটভিয়ার মানুষজন ভালো এবং বেশি মাইনের চাকুরির খোঁজে ইউরোপের অন্যত্র গিয়ে বাসা বাঁধছে, অতীতে যাকে বলা হতো ভাগ্যান্বেষণে৷ বিগত দশকে লাটভিয়ায় জনসংখ্যা হ্রাসের দুই-তৃতীয়াংশ ঘটেছে লাটভিয়ানরা দেশ ছাড়ার ফলে৷
শিশুরা করে খেলা...
ইউরোপের একটির পর একটি দেশে জন্মহার হ্রাসের পিছনে এত ধরনের আর্থ-সামাজিক কারণ আছে যে, তার তালিকা দেওয়া বৃথা৷ নারীমুক্তি থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি – এবং হালে আর্থিক সংকট এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা – সব কিছুকেই তার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক মর্জি ও প্রয়োজন অনুযায়ী৷ কিন্তু বাস্তব সত্য হল, পর্তুগালের মতো একটি দেশে গত বছর জন্মহার ছিল নারী প্রতি ১ দশমিক ৩২টি সন্তান, যদিও দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে নারী প্রতি ২ দশমিক একটি সন্তানের জন্ম হওয়া উচিত ছিল৷
২০১২ সালে গোটা পর্তুগালে জন্মেছে মাত্র ৯০,০০০ শিশু৷ আর ২০৫০ সালে পর্তুগালের প্রতি দশজন বাসিন্দার মধ্যে চারজনের বয়স হবে ৬০-এর উপরে৷ অভিবাসন কিংবা দেশত্যাগ? প্রতিবছর এক লাখ থেকে এক লাখ বিশ হাজার পর্তুগিজ দেশ ছাড়ছে ভাগ্যান্বেষণে৷ যা কিনা দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ!
ইউরোপের সব দেশের ‘পপুলেশন প্রোফাইল' বা জনসংখ্যার কাঠামো যে এরকম ‘অ-টেঁকসই', এমন বলা চলে না৷ যেমন ব্রিটেন একটি ব্যতিক্রম৷ অন্যদিকে জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশে অন্তত অবসরগ্রহণের বয়স বাড়িয়ে সমস্যাটা কিছুটা বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা চলেছে৷ কিন্তু মূল সমস্যাটাকে রাজনীতির নির্ঘণ্টে না তুলতে পারলে ইউরোপের কালে জাপানের দশা হতে পারে: প্রবীণদের দেশ জাপান, যেখানে প্রবৃদ্ধিও ঘটে শম্বুক গতিতে৷
এসি/ডিজি (রয়টার্স)