ইউরোপের ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য একটি সতর্কবার্তা
৮ জুলাই ২০২০ইউরোপীয় ন্যায়বিচার আদালত ইসিজে আগামী বুধবার লুক্সেমবুর্গে একটি মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে৷ তা হল, ইউরোপীয় পরিচয়- ধর্মের স্বাধীনতা৷ এদিকে, জার্মানিতে ইহুদি ও মুসলিমরা তাদের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে, এমনকি ইউরোপে তাদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানও ঝুঁকির মুখে৷
এই যেমন কেস সি ৩৩৬/১৯-তে অচেতন না করে পশু কুরবানির ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে৷ এভাবে পশু কুরবানি বেলজিয়ামে ২০১৯ সাল থেকে নিষিদ্ধ, প্রথমে ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলে এবং পরে ওয়ালোনিয়াতেও৷ বেলজিয়ামে নিষিদ্ধের এই আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবার পর সেখানকার সাংবিধানিক আদালত একে ইসিজেতে পাঠিয়েছে যেন তারা ইইউ চার্টারে যে মৌলিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না যাচাই করে৷ লুক্সেমবুর্গে শুনানি চলছে৷এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে, ইউনরোপের ন্যায়বিচার আদালত ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্ব দেয় কি না৷
তাহলে কি ধর্ম স্বাগত নয়?
আগে কখনো ইউরোপের রাব্বীদের (ইহুদি ধর্মগুরু) সমাবেশ ও মুসলিম বিশ্ব লীগ এমন সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কথা বলেনি৷ এই প্রথম একটি চিঠিতে একসঙ্গে রাব্বীদের প্রধান নেতা পিনচাস গোল্ডস্মিডট ও মুসলিম বিশ্ব লীগের মহাসচিব শেখ মোহাম্মেদ আল-ইসা মতামত দেন৷ দু'জনই মনে করেন, এক্ষেত্রে তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ক্ষু্ণ্ণ হচ্ছে৷
‘‘যদি বেলিজিয়ামের নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকে, তাহলে ইউরোপীয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে বার্তা দিচ্ছে তা পরিষ্কার: ‘আপনারা এখানে স্বাগত নন','' এমন কথা বলা হয়েছে চিঠিতে৷ আরো বলা হয়েছে, ‘‘যদি খাবার খাওয়াকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমরা আশা করতে পারিনা যে, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো ইউরোপে থাকবে এবং সমাজে তাদের অবদান রাখবে৷''
অবশ্যই আপনারা এই মতামতকে এড়িয়ে যেতে পারেন এই বলে: মস্কো থেকে আসা একজন প্রথাগত রাব্বী ও ইসলামের একজন সৌদি প্রতিনিধির কথা আমরা কেন শুনব? কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, পুরোনো শত্রুতার ভাবমূর্তি দূরে ঠেলে সম্পূর্ণ দুই মেরুর দু'জন সংলাপে মেতেছেন৷ মোটের ওপরে, আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা আছে, এমন একটি আন্দোলন তৈরি হয়েছে যা দুর্ভাগ্যবশত খুব কম রাজনৈতিক নেতাই ভাবছেন বা এমনকি লক্ষ্য করছেন৷ এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে জাতীয় ও ইউরোপীয় পর্যায়ে খুব কম লোকই ভাবেন৷
দিন দিন গুরুত্ব হারাচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একত্রিত হবার যে ইউরোপীয় ধারণা, তাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ খ্রিস্টানরা ছিলেন মূল চালিকাশক্তি: কনরাড আডেনাওয়ার, আলচিডে দ্য গাসপেরি, রবার্ট শুমান৷ তাদের ইউরোপে অবশ্যই ধর্ম ও ধর্মের স্বাধীনতা একটি বিষয় ছিল৷ কিন্তু এখন? কয়েক সপ্তাহ আগে, জার্মানির উরসুলা ফন ড্যের লেইয়েন নেতৃত্বাধীন ইইউ কমিশন সারাবিশ্বের জন্য তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির পদটি বাতিলের ঘোষণা দিল৷ আরেকটি উদাহরণ হল, ইস্তানবুলের আয়া সোফিয়া, যা বিশ্বজুড়ে অর্থডক্স খিস্ট্রানদের প্রতীক এবং কয়েক দশক ধরে একটি মিউজিয়ম, একে তুরস্কে এরদোয়ানের ইসলাম অধিগ্রহণ করতে চাইছে৷ ইইউর শীর্ষস্থান থেকে এসব বিষয়ে কোন কণ্ঠস্বর আছে? বার্লিন বা প্যারিস থেকে? না নেই! এর অর্থ এই বিষয়ে ইসিজে বিচারকদের আলাপ-আলোচনা একটি বড় ফ্রেমওয়ার্কের অংশ৷
গোল্ডস্মিডট ও আল-ইসা, একজন ইহুদি ও একজন মুসলিম, তাদের আপীলে পরিষ্কারভাবে ও সময়োপযোগীভাবে যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা হল ধর্মীয় নিয়মে খাবার গ্রহণ (ধর্মীয় উপায়ে পশু কুরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে) আর সম্ভব হবে না৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও এমন নিষেধাজ্ঞার রেফারেন্স তুলে বলা হয়, ‘এটি ইউরোপজুড়ে ইহুদিদের কোণঠাসা করে দেয়া হয়'৷ এরপর ঘটনা প্রবাহ কোনদিকে গিয়েছে তা আমরা জানি৷
‘ইউরোপের মূল নীতি লঙ্ঘন'
‘‘যদিও ধর্মীয় স্বাধীনতা ইউরোপীয় গণতন্ত্রে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদি ব্যক্তি ও সম্প্রদায়গুলো তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন না করতে পারেন, তাহলে তা অর্থহীন,'' ধর্মীয় প্রতিনিধিরা সতর্ক করেন৷ আর কেউ যদি মুসলিমদের হালাল ও ইহুদিদের কোসার খাবার খেতে বারণ করেন, তাহলে তিনি ‘ইউরোপের মূল নীতি লঙ্ঘন করছেন'৷
লুক্সেমবুর্গ বিচারকদের আলোচনা এক বিষয় (এবং প্রায়োগিক আইন নিয়ে বিচারিক আদালতের রায় ও ব্যাখ্যাকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে)- আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অন্য বিষয়৷ তাই ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং এক্ষেত্রে কোথায় ছাড় দেয়া হবে তার এমন পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন যে ধর্মীয় কারণে চেতনানাশক না প্রয়োগ করে পশু কুরবানিকে অনুমোদন দেয়া যায়৷ কারণ জ্যেষ্ঠ ধর্মীয় প্রতিনিধিদের পরিষ্কার বার্তা দেয়ার এমন বিরল ঘটনা আসলে ক্লান্ত ও আত্মনির্ভরশীল ইউরোপের জন্য একটি সতর্কবার্তা৷
ক্রিস্টোফ স্ট্র্যাক/জেডএ