ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাই এক মানবিক শরণার্থী নীতি
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪২০১৪ সালে ইউরোপে যত শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এসেছেন, ১৯৪৫ সাল যাবৎ তা আর দেখা যায়নি৷ সিরিয়া, ইরিট্রিয়া, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইউরোপ অভিমুখে পলায়ন করেছেন৷ ভূমধ্যসাগর, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-সীমান্ত পার হওয়ার প্রচেষ্টায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ পূর্বনির্ধারিত কোটার উদ্বাস্তু হিসেবে ইউরোপে না এলে, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা না করে উপায় নেই – এবং তা শুধু ইউরোপে পৌঁছানোর পরেই করা যায়৷ অর্থাৎ ‘অ্যাসাইলাম'-এর আবেদন দাখিল করার আগে উদ্বাস্তুদের আগে বেআইনিভাবে ইউরোপে ঢুকতে হবে – এ এক আজব পরিস্থিতি৷
মানুষপাচারকারীরাই সাধারণত সেই বেআইনি অনুপ্রবেশের ব্যবস্থা করে থাকে৷ যে অপরাধীরা বোটে করে শরণার্থীদের লিবিয়া থেকে ইউরোপ অভিমুখে পাঠায়, শুধুমাত্র তারাই এই বেআইনি ব্যবসা থেকে কোটি কোটি ডলার মুনাফা করে থাকে৷ একটা অসহ্য পরিস্থিতি, এবং তা শুধু ২০১৪ সাল থেকেই নয়: ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা বহুদিন আগেই উপলব্ধি করেছেন যে, ইইউ-তে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান এবং শরণার্থী সংক্রান্ত নীতি বদলাতে হবে৷
‘‘ইউরোপ দুর্গ'' ভেঙে দাও?
বিশেষ করে উদ্বাস্তু ত্রাণ সংগঠনগুলির দাবি হলো, ইউরোপকে ‘‘দুর্গ'' বানিয়ে না রেখে, অবাধ অভিবাসনের অনুমতি দাও৷ এই দাবি মানবিক ভাবে বোধগম্য হলেও, রাজনৈতিক ভাবে কার্যকরি করা সম্ভব নয়৷ ইউরোপের অধিবাসীদের মধ্যে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ শরণার্থী গ্রহণ করে তাদের সমাজের অঙ্গ করে তোলার প্রস্তুতি – এক কথায় – অনুপস্থিত৷ ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু দেশে ‘‘সমুচ্চ'' বলে অনুভূত রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ক্ষোভ ও প্রতিরোধের সৃষ্টি করেছে৷
কিছু কিছু দেশে বহিরাগত বিদ্বেষী গোষ্ঠীগুলির জনপ্রিয়তা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে৷ এই পরিস্থিতিতে এ কথা বলে কোনো লাভ নেই যে, সিরিয়ার প্রত্যক্ষ প্রতিবেশিদের তুলনায় ইউরোপ খুব কম উদ্বাস্তুকেই স্থান দিয়েছে৷ লেবাননের প্রতি চতুর্থ বাসিন্দা নাকি আজ একজন উদ্বাস্তু৷ ইউরোপকে সেই পরিমাণ উদ্বাস্তু নিতে হলে তাদের সংখ্যা দাঁড়াত সাড়ে বারো কোটি! বাস্তবিক ইউরোপে স্থান পেয়েছেন সাকুল্যে পাঁচ লাখ উদ্বাস্তু৷ শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যাটাকে মেনে নেওয়া তো দূরের কথা, তা-কে বর্তমান পর্যায়ে রাখার সদিচ্ছাও আজ ইউরোপে অবর্তমান৷
ইইউ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে, ইউরোপে বৈধ অভিবাসনের আরো বেশি সুযোগ দেওয়া আবশ্যক, যা-তে শরণার্থীদের মানুষ পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় এবং শরণার্থীরা বিপজ্জনক পন্থায় ইউরোপে আসার চেষ্টা না করেন৷ কিন্তু বৈধভাবে ইউরোপে আসার পন্থা বাড়লে, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, রাশিয়া, ইউক্রেন কিংবা সার্বিয়া থেকে আরো বেশি মানুষ ইইউ-তে আসার চেষ্টা করবেন৷ এই উভয়সংকটের সমাধান কী, তা আপাতত অজ্ঞাত৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীবর্গ ২০১৫ সালেও তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন৷ যে সব দেশ থেকে শরণার্থীরা আসছেন, তাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করে থাকে৷ বাদবাকিদের বিনা ব্যতিক্রমে ফেরৎ পাঠাতে হবে৷ সেটা কি খুব ন্যায্য হবে?
কে থাকবে, কে যাবে
ইউরোপীয় ইউনিয়নে যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন, তাদের মধ্যে গড়ে ৫০ শতাংশ বাস্তবিক সেই স্বীকৃতি পান৷ তবে শরণার্থীরা কোন দেশ থেকে আসছেন, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে: বর্তমানে সিরিয়া থেকে আসা প্রায় সব উদ্বাস্তুর আবেদন মঞ্জুর হচ্ছে, সার্বিয়া থেকে আসা প্রায় সব আবেদন নাকচ হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে শরণার্থীরা ইইউ-তে প্রবেশ করার আগেই তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার সম্ভাবনা বিবেচনা করে দেখার প্রস্তাবটি আবার আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, এবং জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোমাস দেমেজিয়ের তার পুনরুল্লেখও করেছেন৷
ইইউ-এর সদস্যদেশগুলি বর্তমানেই শরণার্থীদের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে, যদি তারা চলতি ডাবলিন নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করে৷ ডাবলিনের নীতিমালা বলছে, শরণার্থীরা প্রথমে যে দেশে পৌঁছাবে, সেই দেশই তাদের দায়িত্ব নেবে এবং তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বিবেচনা করবে৷ কিন্তু ইটালি, গ্রিস, হাঙ্গেরি এবং অপরাপর দেশ তা মেনে চলে না৷ এ বছর ইটালি হাজার হাজার শরণার্থীকে নথিভুক্ত পর্যন্ত না করে অবৈধ অবস্থাতেই আল্পস পর্বতমালা পার হয়ে উত্তরে যেতে দিয়েছে৷
এভাবেই, বাস্তবিক কত মানুষ যে বেআইনিভাবে ইইউ-তে প্রবেশ করে ইউরোপের জনসমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছেন, তা কারো জানা নেই৷ ইউরোপীয় শরণার্থী পরিষদের মতে, সরকারিভাবে ইউরোপে শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের যে সংখ্যা দেখানো হয়, বাস্তবিক সংখ্যা তার তিন থেকে চারগুণ৷