প্রথমে আয় আর সেবা দিন
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬জার্মানিতে কর না দিয়ে থাকা মুশকিল৷ কর দিতে সবাই একরকম বাধ্য৷ প্রতিমাসে বেতনের প্রায় প্রায় অর্ধেক টাকা কেটে বাকি টাকার একটা হিসেব ধরিয়ে দেয়া হয়৷ প্রায় চার বছর ধরে আমিও এই নিয়মের অধীন৷ ধরিয়ে দেয়া হিসেবে পরিষ্কার লেখা থাকে, প্রকৃত বেতন কত আর সব কাটাকুটির পরে পাবো কত৷ প্রথমে বেশ আফসোস হতো, ভাবতাম, ‘‘ইশ, এতগুলো টাকা কেটে নেয়!''
অবশ্য টাকাটা হঠাৎ কাটতে শুরু করেনি৷ নিয়োগপত্রেই বিষয়টির উল্লেখ ছিল৷ প্রতিমাসে কোন খাতে কত টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা থাকে৷ সেখানে স্বাস্থ্য বীমা, অবসর ভাতা, বেকার ভাতা, জার্মানির পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন কর-সহ সব খাতেরই উল্লেখ থাকে৷
এতগুলো টাকা যে কেটে নিচ্ছে, তা নিয়ে কি মনে কোনো অসন্তোষ আছে? এখন আর একদমই নেই৷ না থাকার একটাই কারণ – পারিশ্রমিক থেকে যে টাকা কেটে নেয়া হয়, সময়মতো সমানুপাতিক বা তার চেয়ে বেশি হারে তা ফিরিয়েও দেয় জার্মান সরকার৷
ব্যাপারটা বোঝাতে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শুধু দু'টো উদাহরণ দেবো৷
২০১৪ সালে আমার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল৷ এমন বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না৷ হঠাৎ ঝড়ের মতো এসে সব তছনছ করে দিয়ে যায়৷ কিন্তু হয়ত জার্মানিতে ছিলাম বলেই ঝড়টা শরীর টের পেলেও, মনের ওপর বা পরিবারে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি৷ ডাক্তার রোগ নির্ণয়ের পরই অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলেন৷ অ্যাম্বুলেন্সটাই ছিল মিনি হাসপাতাল৷ ছোট হাসপাতালে শুয়ে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাই এই বন শহরেরই একটি হাসপাতালে৷ দুপুরে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম, বিকেল গড়ানোর আগেই অস্ত্রোপচার শেষ৷ কেউ একবার এসে বলেওনি, অপারেশনে কত টাকা লাগবে৷ বলার দরকারই পড়েনি৷ ডাক্তার শুধু দেখেছেন আমার হেল্থ ইনস্যুরেন্স কার্ড৷ ঐ কার্ডই আমার হয়ে কথা বলেছে, বলেছে, ‘‘এই রোগী জার্মানিতে আসার পর থেকে তাঁর কষ্টের উপার্জন দিয়ে এই দিনটির জন্য কিছু টাকা জমা করেছে৷ সুতরাং তাঁকে সারিয়ে তোলাই প্রথম ও শেষ দায়িত্ব৷ এর মাঝে কোনো কথা নেই৷ চিকিৎসার খরচ নিয়ে কোনো দরাদরির প্রশ্ন নেই৷ প্রশ্ন একটাই –রোগীকে কত তাড়াতাড়ি সারিয়ে তোলা যাবে?''
সারিয়ে তুলতে প্রথমে দরকার ছিল অপারেশন৷ তা তাঁরা কাল বিলম্ব না করেই করেছেন৷ তারপর দরকার ছিল বাকি জীবন নিজেকে সুস্থ রাখার বিষয়ে রোগীকে সচেতন করা, কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া৷ তা-ও তাঁরা দিয়েছেন৷ জার্মান সরকার বা চিকিৎসাসেবকদের কাছ থেকে এর বেশি কী চাইতে পারি আমি?
হার্ট অ্যাটাকের পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, প্রবাসে আর একা থাকা নয়৷ তা পরিবার যদি নিয়ে আসি, চলব কীভাবে? বেতন থেকে যে এতগুলো টাকা কেটে নেয়, বাকি টাকায় সংসার চালানো যাবে? সহকর্মীরা বললেন, ‘‘সে চিন্তা সরকারের৷ পরিবার এলে এত টাকা কাটবে না৷ কম কাটবে৷ ফলে আয় বেড়ে যাবে৷''
সত্যিই তাই৷ পরিবারের সদস্যদের নাম এখানে নথিভুক্ত হওয়ার পরই মাস শেষে একটু বেশি টাকা ব্যাংকে জমা হতে লাগল৷ কিছুদিন পর টাকার অঙ্কটা আরেকটু বাড়ল৷ কেন জানেন? আমার সন্তান যে স্কুলে যায়! তার একটা খরচ আছে না? সেই খরচের একটা অংশ দেয়ার দায়িত্ব আপনাআপনিই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে জার্মান সরকার৷ আমি শুধু নিয়ম মেনে জানিয়েছিলাম, সন্তান স্কুলে যাচ্ছে, লেখাপড়া করছে৷
কর সব দেশের সব উপার্জনক্ষম নাগরিকেরই দেয়া উচিত৷ তবে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের ন্যূনতম সামর্থ্য না থাকলে মানুষ কর দেবে কী করে? তাই সেদিকটা মাথায় রাখতে হবে৷ আর কর নেয়ার আগে যথেষ্ট নাগরিক সেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকে৷
বন্ধু, আশিষ চক্রবর্ত্তীর এই ব্লগ পোস্টটা আপনার কেমন লাগলো? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷