আসিফকে ছাড়াই ভোট হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩তিনি আগুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। আর এই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী উকিল আব্দুস সাত্তার সংসদ থেকে পদত্যাগ করা বিএনপির সাত এমপির একজন। তিনি সংসদ সদস্যপদ ছাড়ার পর বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করে নির্বাচনে দাঁড়ান। বিএনপিও তাকে পরে তাকে বহিস্কার করে। কিন্তু এই আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী ছিল না। সাত্তারের সমর্থনে নিজেদের প্রার্থীকে বসিয়ে দেয় তারা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ‘জয়বাংলা' স্লোগান দিয়ে সাত্তারের ‘কলার ছড়া' মার্কায় ভোট চেয়েছেন। সাত্তারকে জেতাতে আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করানো হয়। সাত্তার এর আগে পাঁচবার বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাচনে মোট চার জন প্রার্থী । তারা হলেন আবদুস সাত্তার (কলার ছড়া), জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী (লাঙ্গল), জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (গোলাপ ফুল) এবং আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবু আসিফ আহমেদ (মোটরগাড়ি)।
ভোট কেন্দ্রে আবু আসিফের স্ত্রী
আবু আসিফ আহমেদ ২৭ জানুয়ারি বিকেল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তবে তিনি তার মোবাইল ফোন রেখে যান। বুধবার নির্বাচনের দিনও তিনি ফিরে আসেনি। তার স্ত্রী মেহেরীন আসিফ বুধবার ভোট কেন্দ্রে গেলেও তিনি ভোট দেননি।বুধবার বেলা একটার দিকে আশুগঞ্জ উপজেলার শ্রমকল্যাণ কেন্দ্র ভোটকেন্দ্রে তিনি ভোট দিতে যান। এ সময় প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রের ২ নম্বর বুথে নিজের ভোট দিতে যান। কিন্তু ভোট না দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান তিনি।
সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটি একটি অসুস্থ নির্বাচন। কিছুক্ষণ আগে এসে দেখলাম, একজন ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে অন্যজন ভোট দিচ্ছেন। দিনভর সব কেন্দ্রেই এমন হচ্ছে। কর্মীদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিচ্ছে। আগেও এজেন্টদের ভয় দেখানো হয়েছে। তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে। যেহেতু নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, সেহেতু রেজাল্টটা কী আসবে, আপনারা বুঝতে পারছেন। আমাদের কর্মীরা পলাতক। এ অবস্থায় আমি আর কী বলতে পারি? প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নিখোঁজ। ভোটের এই পরিবেশ দেখে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব কেন্দ্রেই একজনের ভোট আরেকজন দিচ্ছেন। এটা কি নির্বাচন? ভোটের এই পরিবেশ দেখে আমি ভোট দিইনি।''
আসিফ এখনো নিখোঁজ
নিখোঁজের ৯২ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার আসিফের স্ত্রী মেহেরীন আসিফ স্বামীর সন্ধান চেয়ে এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলমের কাছে লিখিত আবেদন করেন। তিনি আবেদনে বলেন," মোটরগাড়ি প্রতীক বরাদ্দের পর আশুগঞ্জ ও সরাইলে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন আবু আসিফ আহমেদ। তিনি ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছিলেন। কিন্তু ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলে আশুগঞ্জ বাজারের বাসায় মুঠোফোন রেখে তিনি বের হয়ে যান। আর ফেরেননি। এরপর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না।”
তিনি আরো অভিযোগ করেন, "২৫ জানুয়ারি বুধবার দিবাগত রাতে আসিফের নির্বাচনি প্রচারণার প্রধানের দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৩ জানুয়ারি আশুগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। যে ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে মুসার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কারী মেহেরীনের ছোট ভাই শাফায়াত সুমন ভয়-ভীতির কারণে নির্বাচনি এলাকায় যেতে পারছেন না। এর মধ্যে পুলিশ পরিচয়ে সাদাপোশাকধারী লোকজন বাসায় অযথা তল্লাশি করে হয়রানি করছে। প্রতিনিয়ত আসিফের কর্মী-সমর্থকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বাড়ির সামনে কিছু পুলিশ আসা-যাওয়া করছে। বাসায় কোনো লোক এলে তার ছবি তুলছে, ভিডিও করছে।”
আসিফকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
মেহেরীন আসিফ বুধবার সন্ধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন," আমি আশা করেছিলাম আজকে (বুধবার) নির্বাচনের দিন আমার স্বামী ফিরে আসবে। কিন্তু আজকেও তিনি এলেন না। আমি তাকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত চাই। আমার সঙ্গে পুলিশ বা নির্বাচন কমিশনের কেউ যোগাযোগ করছেন না। কমিশন সময় বেঁধে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করার পরও তাকে উদ্ধার করা হলো না। নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল এই নির্বাচন স্থগিত করা।”
তিনি বলেন, " আমাকেও নজরবন্দি রাখা হয়েছে। আমি ঘর থেকে বের হতে পারছি না। আমাকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। আমার স্বামী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হতেন। সে কারণেই তাকে নিখোঁজ করা হয়েছে।”
অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন বলেন," আসিফের পরিবার থানায় জিডি করেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাইনি। তাকে উদ্ধারের জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাকে পাওয় গেলে আমরা বুঝতে পারবো তার ক্ষেত্রে কী ঘটেছিলো।”
আর যে এলাকা থেকে আসিফ নিখোঁজ হন সেই আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ রহমান বলেন," তিনি, নিখোঁজ, অপহরণ না আত্মগোপনে আছেন তা এখনো বলা যাচ্ছে না। আমরা সবগুলো বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করছি। কিন্তু এখনো কোনো খোঁজ পাইনি। আমাদের কাছ কোনো আপডেট নাই।”
আসিফের স্ত্রী-র কথোপকথনের অডিও
এদিকে আসিফের মেহরীন আসিফের সঙ্গে এক ব্যক্তির টেলিফোনে কথোপকথনের অডিও ফাঁসের খবর প্রকাশ করেছে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল৷ প্রতিবেদনে বলা হয় কথিত টেলিফোন কথোপকথানে মেহরীন বাড়ির কেয়ারটেকারকে দ্রুত কিছু কাপড়-চোপড় আসিফকে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ কথোপকথনের এক পর্যায়ে বাড়ির ক্যামেরা দ্রুত বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ার কথা রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়৷
এ প্রসঙ্গে আশুগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ রহমান বলেন," তার (আসিফ) স্ত্রী-র কথপোকথনের একটি অডিও আমরাও পেয়েছি। এটি ভাইরাল হয়েছে। সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে। ওই অডিওর বক্তব্যও আমরা যাচাই করে দেখছি। তাকে উদ্ধারের সবগুলো ক্লুই আমরা ব্যবহার করছি।”
কেয়ারটেকারের সঙ্গে মেহেরীন আসিফের ওই অডিও কথোপকথনের ব্যাপারে মেহেরীন জানান," আমার বাসার ডিসলাইন কাটা। ইন্টারনেট নাই। আমি টিভি দেখতে পারি না। পত্রিকাও দেখিনি। ফলে ওই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।
ছয়টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোটার উপস্থিতি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে । স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রেই অনেক সময় দুই-চার জন ভোটার উপস্থিত হন। পোলিং কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা অলস বসে ছিলেন বলেও জানান তারা। আব্দুস সাত্তারের নির্বাচনি এজেন্ট ছাড়া আর কোনো প্রার্থীর এজেন্টদের তেমন একটা দেখা যায়নি।
আসিফের স্ত্রী মেহেরীন বলেন," আমার স্বামী নিখোঁজ থাকায় আমরা ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তবে এলাকার ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে ভোট বর্জন করেছেন। এটা ভোটার-শূন্য নির্বাচন হয়েছে। আমাদের চার-পাঁচজন এজেন্ট সাহস করে কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ঢুকতে দেয়া হয়নি।”
জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহগীর আলম ভোটার তেমন না থাকা সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেন," ভোটার আনা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব না৷ এটি প্রার্থীদের দায়িত্ব। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে আবহাওয়া একটি কারণ হতে পারে, প্রার্থীরা ভোটারদের মোটিভেট করতে পারেননি, সেটাও হতে পারে। ”
সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের মোট ভোটার তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩১৯ জন। মোট ১৩২টি কেন্দ্র ও ৮২৬টি ভোটকক্ষে ভোট গ্রহণ হয়েছে। সব কেন্দ্রে ভোট হয়েছে ইভিএমে।