‘আসাম টি’ ও বুনো হাতি
৫ এপ্রিল ২০১৭বাপ-মা নেই, এমন একটি বাচ্চা হাতিকে মানুষ করা সোজা কাজ নয়৷ বন্যপ্রাণী ত্রাণ ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা দিনের বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় কাটান বাচ্চা হাতিগুলোকে আদর করে ও তাদের সঙ্গে খেলতে – নয়ত নাকি তারা বাঁচে না, অতীতে যেমন দেখা গেছে৷
বন্যপ্রাণী ত্রাণ কেন্দ্রের চত্বরে ১৩টি ছোট গণ্ডারের ছানা, এছাড়া হগ ডিয়ার, চিতাবাঘ ও নানা ধরনের বানর রাখা আছে৷ এদের অধিকাংশই এসেছে কাছের কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক থেকে৷
এই বাচ্চা হাতিটিকে একটি নালা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে – যা প্রায়ই ঘটে থাকে৷ এছাড়া গাড়ি দুর্ঘটনা তো লেগেই আছে৷
হাতি পোষা
ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার (আইএফএডাবলিউ) এবং ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া-এর (ডাব্লিউটিআই) ড. পাঞ্জিত বসুমাতারি বললেন, ‘‘বাচ্চা হাতিদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা খুব জোরদার নয়৷ কাজেই আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হয়৷ আগে একটা বাচ্চা হাতির কাছে ২৪ ঘণ্টা একজন পরিচারক থাকত, কিন্তু তাও অনেক ভুল হতে পারে৷ বাচ্চা হাতিরা সর্বত্র তাদের শুঁড় ঢোকায় – মানুষের কাছ থেকে ওরা নানা ধরনের রোগ-জীবাণু পেতে পারে৷''
যে কারণে ডক্টর বসুমাতারি বাচ্চা হাতিদের সঙ্গে তাদের মানুষ বাপ-মায়েদের ঘাঁটাঘাটি যতটা সম্ভব কম রাখার চেষ্টা করেন৷ তবে মায়ের শরীরের তাপ আবার বাচ্চা হাতিদের গরম রাখে – তাই বিকল্পের ব্যবস্থা করতে হয়েছে৷ দু'টি করে বাচ্চা হাতিকে এখন একটি কাঠের বেড়া দেওয়া চত্বরে রাখা হয় – দক্ষিণ আফ্রিকার মতো যাকে এখানেও ‘ক্রাল' বলা হয়৷ ‘ক্রালে' খেলবার জায়গা তো আছেই, এছাড়া ঢাকা দেওয়া একটি শোবার জায়গাও আছে৷ শীতের রাত্রে বাচ্চা হাতিদের গায়ে কম্বল ও পায়ে মোজা পরানো হয়৷
ড. বসুমাতারি জানালেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করি, বাচ্চা হাতিগুলোকে যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে রাখতে, অর্থাৎ বাড়িতে না রেখে বাড়ির বাইরে রাখতে৷ সেটা অন্তত কিছুটা মুক্ত প্রকৃতির মতো, যখন ওরা ওদের মায়েদের সঙ্গে ছিল৷ এর ফলে পরে ওদের আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া সহজ হয়৷''
চা-বাগান বাড়ছে
আসামে মানুষ আর বন্যপ্রাণী গা ঘেঁষাঘেষি করে থাকে৷ এদিকে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র আর কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের মধ্যে রয়েছে এই এলাকার সবচেয়ে যানবহুল রাস্তা৷ এখানকার মানুষের জীবিকা চলে পর্যটন ও কৃষিকাজ থেকে৷ এছাড়া আছে অসংখ্য কাজের হাতি, পোষা হাতি৷ রাস্তার পাশ থেকেই উঠে গেছে চা-বাগানের পর চা-বাগান৷ সুবিখ্যাত ‘আসাম টি' এখানেই তৈরি হয়ে থাকে৷ তবে তার কুফলও আছে৷
চাষি পদ্ম গোগোই জানালেন, ‘‘সমস্যা বেড়েই চলেছে৷ চা-বাগানগুলো ক্রমেই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠছে আর হাতিদের জন্য আরো কম জঙ্গল বাকি থাকছে৷ কাজেই ওরা এখানে নেমে এসে আমাদের ক্ষেতখামার তছনছ করে, বাড়িঘরদোর ভাঙে, মানুষ মারে৷ বুনো মোষরা ন্যাশনাল পার্ক ছেড়ে বাইরে আসে খাবার খুঁজতে৷ বাঘেরা তাদের পিছনে পিছনে আসে শিকারের খোঁজে৷ কাজেই বাঘের হাতে মানুষও মরে৷''
কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে জীবজন্তুদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ৷ এখানে গণ্ডারদের সংখ্যা যতটা স্থিতিশীল, সেটা বিশ্বের আর কোথাও নয়৷ কিন্তু এখানকার মানুষদের মাঝেমধ্যে মনে হয়, সরকারের কাছে যেন মানুষের চেয়ে জীবজন্তুর দামই বেশি!
তাই মানুষজন নিজেরাই যেটুকু পারেন, তা করেন৷ গাঁয়ের পুরুষরা প্রতি রাত্রে জাতীয় উদ্যান আর তাদের ক্ষেতখামারের মাঝখানের সীমানায় টহল দেন৷ টর্চের আলো ফেলে তারা বুনো জন্তুদের পার্কে ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টা করেন৷ সত্যিকারের বিপদ দেখা দিলে অবশ্য তাদের বিশেষ কিছু করবার নেই – তবে এই টহলদারির ফলে তাদের পরিবারের লোকজনেরা নাকি স্বস্তিতে ঘুমোতে পারেন৷
হাতিরা যাবে মানসে
হাতিদের আবার স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা শিখতে হবে৷ গত পাঁচ বছরের হাতির বাচ্চাদের নিয়ে একটা ছোটখাট দল তৈরি হয়েছে৷ রোজ হাঁটতে বেরিয়ে এই হাতিরা শেখে, জঙ্গলে তারা কী খেতে পারে অথবা না পারে – আর সেই সঙ্গে, কী করে মানুষের বসতি আর রাস্তা থেকে দূরে থাকতে হয়৷ পরের বছর তাদের অন্য একটা বড় ন্যাশনাল পার্কে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে৷
বাচ্চা হাতিদের পরিচারক তরুণ গোগোই বললেন, ‘‘আমরা ওদের বোতলে দুধ খাইয়ে বড় করছি৷ এর পর ওদের যখন মানস পার্কে নিয়ে যাব – তখন খুব মন খারাপ হবে৷ তবে আমি যদি কখনো-সখনো ওখানে গিয়ে ওদের নাম ধরে ডাকি, তাহলে ওরা আমাকে খুঁজতে আসে৷ ওদের স্বাভাবিক পরিবেশে ওদের দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগে: বনে-জঙ্গলে, সেখানেই তো ওদের জায়গা৷''
খোকা হাতিদের মানসে যেতে এখনও অনেক দেরি – তবে এরই মধ্যে ওদের দেখলে কে বলবে যে ওরা একটা হাতির পাল নয়?