আল জাজিরার প্রতিবেদনকে ‘বেপরোয়া অপপ্রচার’ বলছে ঢাকা
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটি এরই মধ্যে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে৷ এর জবাবে সে রাতেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি প্রকাশ করা হয়৷ সেখানে এই প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যা ও মানহানিকর' বলে আখ্যা দেয়া হয়৷ বলা হয়, একটি গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে রাজনৈতিক ছক বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে৷
"কিছু উগ্রপন্থি ও তাদের সহযোগী, যারা লন্ডন এবং বিভিন্ন জায়গায় থেকে এসব করছে, তাদের এই বেপরোয়া ‘অপপ্রচারকে' বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাখ্যান করছে৷ বাংলাদেশের অসাধারণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য যেখানে সরকারের ভূমিকা প্রমাণিত, সেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সরকারকে কক্ষচ্যুত করার লক্ষ্য নিয়ে সাজানো হীন রাজনৈতিক ছক বাস্তবায়নে আল জাজিরা নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে, এটা হতাশাজনক,” বিবৃতিতে বলা হয়৷
কী ছিল সেই প্রতিবেদনে?
‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার'স মেন' নামের ঐ প্রতিবেদনে আল জাজিরা সামি (ছদ্মনাম) নামের হাঙ্গেরিতে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্যক্তির সহায়তায় হারিস আহমেদ নামের এক ‘আসামী'র পরিচয় উন্মোচন করে৷ হারিস বুদাপেস্টে ‘মোহাম্মদ হাসান' নামে বসবাস করছিলেন৷ গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত সেই ব্যক্তির কথার ওপর ভিত্তি করে তারা ঘুস ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকারি ও রাজনৈতিক পদপদবী, কেনাকাটায় দুর্নীতির যোগসাজশের ইঙ্গিত দেয়৷
একইসঙ্গে সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের সহোদর হওয়ায় ঐ ব্যক্তি তার উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগকে ‘কাজে লাগিয়ে' এসব অর্থ উপার্জন করেন বলে অভিযোগ তোলা হয়৷ আহমেদ পরিবারের বাকি সদস্যরাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট, এমন যোগসূত্র তৈরির চেষ্টা করা হয় প্রতিবেদনে৷
প্রতিবেদনে তৃতীয় যে বিষয়টি তুলে ধরা হয়, তা হলো, ইসরায়েলের একটি কোম্পানির কাছ থেকে ফোনের নজরদারির প্রযুক্তি কিনছে বাংলাদেশ৷ ‘পিকসিক্স' নামের ঐ কোম্পানির সঙ্গে ২০১৮ সালে একটি চুক্তির দলিল হাজির করেছে আল জাজিরা৷ হাঙ্গেরিতে একজন আইরিশ মধ্যস্থতাকারীর সহযোগিতায় দুই ইসরায়েলির সঙ্গে একটি বৈঠকের কিছু অংশও তুলে ধরা হয়৷ পিকসিক্স প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসরায়েলের কয়েকজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা৷ তবে ক্রয় চুক্তিতে সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী দেশের নাম বদলে হাঙ্গেরি উল্লেখ করা হয়েছে৷
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল থেকে নজরদারি প্রযুক্তি কেনার চুক্তির বিষয়টি নাকচ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ইসরায়েলের সঙ্গে আমরা কোনো চুক্তি করিনি৷''
প্রতিবেদনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া জেমস ম্যালনি সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক কোম্পানি সভরেইন সিস্টেমস-এর প্রতিনিধি৷ পরে আল জাজিরা তার প্রতিক্রিয়ার জন্য যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘‘সভরেইন সিস্টেমস বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি৷''
এছাড়া প্রতিবেদনের বাকি অংশগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছে ঢাকা৷ এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলে, ‘‘এই প্রতিবেদন একগুচ্ছ বিভ্রান্তিকর শ্লেষ আর বক্র ইংগিত ছাড়া আর কিছু নয়, যা আসলে চরমপন্থি গোষ্ঠী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কুখ্যাত কিছু ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘অপপ্রচার', যারা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ রাষ্ট্রের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক নীতির বিরোধিতা করে আসছে৷''
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘‘আল জাজিরার প্রতিবেদনে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মূল সূত্র একজন সন্দেহভাজন আন্তর্জাতিক অপরাধী, যাকে আল জাজিরাই ‘সাইকোপ্যাথ' আখ্যায়িত করেছে৷ প্রধানমন্ত্রী বা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওই ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম প্রমাণও সেখানে নেই৷ আর মানসিক ভারসাম্যহীন কারও কথার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া একটি আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেলের জন্য বড় ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক৷''
আইএসপিআর-এর বিবৃতি
আন্তবাহিনী জনযোগাযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআরও আল জাজিরার প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতোই সেখানে ‘কঠোর ভাষায় নিন্দা’ জানিয়ে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দেয়া হয়েছে৷
প্রতিবেদনের কিছু অংশের অভিযোগের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টাও রয়েছে সে বিবৃতিতে৷ সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়ের ভিডিও যে অংশে দেখানো হয়েছে, সে বিষয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘দেশের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাগণের বিভিন্ন দাপ্তরিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কার্যক্রমের ভিডিও ক্লিপ ও ছবি চাতূর্যের সাথে সম্পাদনা এবং অডিও সংযোজন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে৷’’
ইসরায়েল থেকে ইন্টারনেট ও মোবাইল মনিটরিং সরঞ্জামাদি ক্রয় সংক্রান্ত তথ্যকে মিথ্যা দাবি করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে আইএসপিআর৷ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহারের জন্য হাঙ্গেরির একটি কোম্পানি থেকে সিগন্যাল সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে, কিন্তু সেটিকে প্রতিবেদনে ইসরায়েল থেকে আমদানি করা মোবাইল মনিটরিং প্রযুক্তি হিসেবে অভিহিত করার অভিযোগ আল জাজিরার বিরুদ্ধে করেছে আইএসপিআর৷
জেডএ/এসিবি (বাসস, আল জাজিরা)