আমাদের ‘বর্ণবাদ’
২৫ নভেম্বর ২০১৫সমাজ প্রতিমুহূর্তে যেন বলছে, ‘কালো মেয়ে ভালো নয়, ফর্সা মেয়ে ভালো৷' বিয়েতে ফর্সা মেয়ের ব্যাপক চাহিদা৷ কালো মেয়ের উলটো হাল৷ যৌতুক বা অন্য কোনো প্রণোদনা ছাড়া তাদের পাত্র পাওয়া ভারি কঠিন৷ ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে৷ কিন্তু ব্যতিক্রম তো নিয়ম, প্রতিষ্ঠিত সত্য বা সবার মেনে নেয়া বাস্তবতা নয়!
বাস্তবতা হলো, এই একুশ শতকেও গায়ের রং কালো হলে ‘মেয়ের বিয়ে কী করে হবে' – এই ভাবনায় কাহিল হতে হয় বাবা-মা-কে৷ জন্মের পর থেকেই চলে মেয়েকে ফর্সা করার প্রাণান্ত চেষ্টা৷ কাঁচা হলুদ, দুধের সর, মুলতানি মাটি, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি – শত উপচারের অত্যাচারে অনুচ্চার থাকে সম্ভাবনাময়ীদের কত কষ্ট, কত স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় শুধু ‘পাত্রস্থ' হওয়ার লক্ষ্যের দিকে ছুটে ছুটে৷ ছুটে ‘সুপাত্র' পায় হয়ত লাখে একজন৷ এ সমাজ কি সুপাত্র তৈরির উপযুক্ত হয়েছে এখনো যে ‘কালো মেয়ে' হাত বাড়ালেই ভালো বর পাবে?
সমাজকে তৈরির চেষ্টাই বা কোথায়? সাহিত্যে কালো মেয়ের প্রশস্তির আদর্শ উদাহরণ খুঁজতে গেলেই সবার আগে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি'৷
‘‘কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ৷
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক৷''
কিংবা মনে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের শ্যামা সংগীত, ‘‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন৷'' শামসুর রাহমানের ‘কালো মেয়ের জন্যে পংক্তিমালা'-র পর যে মেয়েদের গায়ের রং ফর্সা নয়, তাঁরা বাংলা কবিতায় খুব একটা এসেছেন কি?
সর্বত্র তথাকথিত ফর্সা মেয়ের চাহিদা৷ ফ্রন্ট ডেস্ক কিংবা রিসেপশনে, নাটকে, সিনেমায়, অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়, সংবাদ পাঠে- সব জায়গায়৷ রং ‘ফর্সা' নয়, অথচ খুব যোগ্য – এমন কেউ কেউ কালেভদ্রে সুযোগ পেয়েছেন বৈকি৷ তবে কালো রং আড়াল করে, অর্থাৎ চড়া প্রসাধনে ত্বক ঢেকে তবেই তারা পেয়েছেন যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ৷
বিষয়গুলো নিয়ে কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. কাবেরি গায়েনের সঙ্গে৷ কালো মেয়েদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরতে গবেষণা করেছেন তিনি৷ ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের চারটি প্রধান দৈনিকে প্রকাশিত ৪৪৬টি পাত্র চাই, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে পরিষ্কার দেখেছেন, সমাজে কালো মেয়েরা ভয়ানকভাবে অবজ্ঞার শিকার৷ বিয়ের জন্য ফর্সা মেয়েই পরম আকাঙ্ক্ষিত৷ বিষয়টির আরো গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে কাবেরি জেনেছেন, ফর্সা না হওয়ায় শহরে-গ্রামে অসংখ্য নারী গঞ্জনা, নির্যাতন সয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে কিংবা আত্মঘাতী হয়৷
টেলিফোন সাক্ষাৎকারেও এসব বিষয়ে কথা বলেছেন কাবেরি গায়েন৷ তবে জানাতে ভোলেননি, দৈনিক সংবাদপত্রের শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন নিয়ে গবেষণাকর্ম সম্পাদনের ১৫ বছর পরেও সমাজে খুব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না দেখে তিনি কিঞ্চিত হতাশ৷
কাবেরি লক্ষ্য করছেন, এখনো ফর্সা মেয়েকেই আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে সর্বত্র৷ এই ভ্রান্তি, এই অঘোষিত সামাজিক অন্যায়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছিলেন মোস্তাফা সরয়ার ফারুকী৷ কাবেরি গাযেন মনে করেন, সেই বিজ্ঞাপনেও পরোক্ষভাবে ফর্সা রংকেই বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে৷
কালো মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য কিছু করণীয় সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়েছেন কাবেরি গায়েন৷ তিনি মনে করেন, আইন করে এবং শাস্তি দিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো যাবেনা৷ দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হলে কালো মেয়েরাও যে মানুষ এ কথাটা সবাইকে আগে খুব ভালো করে মনে করিয়ে দিতে হবে৷
তাঁর মতে, কালো মেয়েদের মানুষ ভাবতে সবাই ভুলে যায় বলেই এত অপমান, এত অত্যাচার, এত বঞ্চনা৷
কালো মেয়েদের আলোর পথ খুঁজে নেয়ার আরেকটি উপায়ের কথাও বলেছেন কাবেরি গায়েন৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য করে তোলা৷ সৌন্দর্যের তথাকথিত সংজ্ঞাকে তুচ্ছ করার মতো যোগ্য করে নিজেকে তৈরি করা৷ নারী যোগত্যায় যত অগ্রগামী হবে, অধিকারবঞ্চিত করা ততই হবে দুঃসাধ্য৷
কালো মেয়ের জন্য ‘জগৎ' তো আগেও প্রতিকূলই ছিল৷ নইলে ‘কৃষ্ণকলি'-র পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ কি ‘কালো মেয়ে' নামের কবিতাও লিখতেন? কবিগুরু সে আমলেই লিখেছিলেন,
‘‘পাশের বাড়ির কালো মেয়ে নন্দরানী
ওই খানেতে বসে থাকে একা,
শুকনো নদীর ঘাটে যেন বিনা কাজে নৌকোখানি ঠেকা৷
বছর বছর করে ক্রমে
বয়স উঠছে জমে৷
বর জোটে না , চিন্তিত তার বাপ;
সমস্ত এই পরিবারের নিত্য মনস্তাপ
দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি হাওয়ায় আছে যেন ঘিরে
দিবসরাত্রি কালো মেয়েটিরে৷''
নন্দরানীদের সময় পেছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে এসেছে নারী৷ নারী ধীরে ধীরে অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে, নিজের গুরুত্ব বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে কমছে ‘পাত্র চাই', ‘পাত্রী চাই' বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব৷ চলমান এই ধারা সব মেয়ের জন্যই আশার কথা৷
মেয়েদের শুধু গায়ের রং দিয়ে বিচার করা কী ঠিক? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷