বিধবারা ‘মরতে প্রস্তুত'
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর গুলগোতাইয়ের মনে হচ্ছিল, পুরো দুনিয়াটাই বুঝি তাঁর মাথার উপরে ভেঙে পড়েছে৷ মাত্র তিন মাসে আগে বিয়ে হয় তাঁর৷ আর এরকম হঠাৎ করেই কিনা চির বিদায় নিল স্বামীটি! বিধবা হিসেবে জীবনযাপন করতে চাননি গুলগোতাই৷ তাই সিদ্ধান্ত নিলেন, এক বোতল অ্যাসিড পান করে চলে যাবেন দুনিয়া ছেড়ে৷
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ময়দান ওয়ারদাক প্রদেশের বাসিন্দা গুলগোতাই৷ পাশের প্রদেশ গজনিতে যেদিন সাইকেল বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, সেদিন তিনি বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করছিলেন৷ ঐ দিন বোমা বিস্ফোরণে দুই ব্যক্তি নিহত হয়৷ আহত সাতজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ গুলগোতাইয়ের স্বামীও ছিলেন আহতদের মধ্যে৷ গুরুতর আহত অবস্থায় খানিকক্ষণ বেঁচে ছিলেন তিনি৷ এরপর সব শেষ৷
অল্প বয়সি এই বিধবার ভাই মোহাম্মদ আজিম জানান, স্বামীর মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পায় গুলগোতাই৷ তাঁর আত্মহত্যার চেষ্টা প্রসঙ্গে আজিম বলেন, ‘‘সেরাতে গুলগোতাই তার এক বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে ছিল৷ ঘরের মধ্যে কিছু একটা খুঁজছিল সে৷ এ জন্য বান্ধবীকে একটি প্রদীপ উঁচু করে ধরতে বলে গুলগোতাই৷ এরপর অ্যাসিডের বোতল খুলে তা পান করে সে৷ তবে সময়মত তার বান্ধবী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়৷''
মেয়েরা আর সহ্য করতে পারছে না
গুলগোতাইয়ের মতো ভাগ্যহত মেয়ের সংখ্যা আফগানিস্তানে কম নয়৷ গত তিন দশকে যুদ্ধের সময় কয়েক হাজার মেয়ে তাঁদের স্বামী বা অন্য পুরুষ আত্মীয়কে হারিয়েছেন৷ যেহেতু তাঁরা পুরুষের উপর নির্ভরশীল, তাই স্বামী বা নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর ফলে মানসিক এবং আর্থিকভাবে ভেঙে পড়েন তাঁরা৷ এভাবে একসময় কঠিন হতাশায় ডুবে যায়৷
গজনি প্রদেশের প্রধান চিকিৎসক মোহাম্মদ হামেট জানান, তাঁর হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনজন মেয়ে ভর্তি হন, যাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদ এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে মেয়েরা আত্মঘাতী হয়ে ওঠে৷ কারণ তারা এত চাপ সহ্য করতে পারে না৷ সৌভাগ্যক্রমে, গুলগোতাইকে যথাসময়ে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল৷ সে এখন আমাদের একটি ওয়ার্ডে ভর্তি আছে৷ তার অবস্থা সংকটজনক নয়৷''
চিকিৎসকের বক্তব্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে, গুলগোতাইয়ের ভাগ্য ভালো এবং শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি৷ কিন্তু তাঁর মূল সমস্যা মানসিক৷ মাত্র ২২ বছর বয়স গুলগোতাইয়ের৷ অথচ এই বয়স থেকেই কিনা বিধবা জীবন কাটাতে হবে তাঁকে৷ আফগান সমাজের কথা চিন্তা করলে, নতুন একজন স্বামী তিনি খুঁজে পাবেন বলে মনে হয় না৷ সেদেশের রীতি অনুসারে, বিধবারা সাধারণত মৃত স্বামীর কোনো ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ কিন্তু গুলগোতাইয়ের ভাগ্যে সেরকম কিছু আছে কিনা তাও পরিষ্কার নয়৷
নারী, শান্তি এবং নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ওয়াজমা ফ্রগ মনে করেন, যেদেশে মেয়েরা মূলত স্বামীর উপর নির্ভরশীল, সেদেশে বিধবরা স্বাভাবিকভাবেই অনেক দুর্বল হন৷ তিনি বলেন, ‘‘(বিধবা) নারীরা বেঁচে থাকার চাইতে মরে যেতে চান৷ আর এজন্য অনেক কারণও রয়েছে৷ অনেক সময় তাঁরা বিধবা হিসেবে জীবনযাপনেরও অনুমতি পান না৷ উদাহরণস্বরুপ, এক মেয়ের কথা বলা যেতে পারে, যে এখন বিশেষ আশ্রয়ে আছে, সে তার বাবা ও শ্যালকের কাছ থেকে অসদাচরণ এবং যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল৷ এরকম অনেক কারণে মেয়েরা স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা হিসেবে বেঁচে থাকতে চায় না৷''
উল্লেখ্য, আফগানিস্তানে বর্তমানে ২৫ লক্ষ বিধবা বাস করেন৷ শুধু কাবুলেই এঁদের সংখ্যা সত্তর হাজারের মতো৷ সংখ্যার বিচারে সেদেশের মোট জনশক্তির ১২ শতাংশই বিধবা৷ এদের অধিকাংশই নিরক্ষর এবং তুলনামুলকভাবে কম বয়সি৷
মোটের উপর, আফগান সমাজে একজন বিধবাকে বাজে মহিলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ বেঁচে ফিরে গুলগোতাইকেও এই সমাজের মোকাবিলা করতে হবে৷ কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? পরিবার অবশ্য আশা করছে, গুলগোতাই আর আত্মহত্যার চেষ্টা করবে না৷ কিন্তু সমাজ যে বড় নিষ্ঠুর!