আন্দোলন ও সহিংসতায় লাভ হেফাজত, হাসিনা ও মোদীর
২ এপ্রিল ২০২১প্রথম কথা হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতা লালনের প্রশ্ন আসবে কেন? বামদলগুলো কি এমন আন্দোলন করেছে যার জন্য আপনার মনে হচ্ছে যে তারা সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকছে? বাম ছাত্র সংগঠনগুলো মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বা বিক্ষোভ প্রকাশ করছে, এটার সাথে সাম্প্রদায়িকতার কী সম্পর্ক?
দেশের বিভিন্নস্থানে হেফাজতের আন্দোলনকারীদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ তো আরও জোরদারভাবে করা উচিত ছিল৷ শুধু হেফাজত বলে না, যে-কোনো নিরস্ত্র লোককে তার প্রতিবাদের কারণে খুন করা তো গ্রহণযোগ্য না, এর সাথে সাম্প্রদায়িকতার কী সম্পর্ক? বরং এটা অভিযোগ আছে বামদলগুলোর বিরুদ্ধে যে, তারা হেফাজতে ইসলামের লোক হিসেবে যারা খুন হয়েছে, তারা হেফাজতের আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত ছিল বিধায় বামদলগুলো যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে সেটার প্রতিবাদ করে নাই৷
আমি মনে করি, এই অভিযোগ সত্য৷ কারণ যে কোনো ধরনের দমন, পীড়ন বা রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা তো বামদলগুলোর দায়িত্ব, সেটা তারা কেন করবে না?
আন্দোলনকারীরা যে দলেরই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় হলে প্রতিবাদ করতে হবে৷ মোদীর আগমনের প্রতিবাদ করার সাথে তো সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক নাই৷ এখন নেপালের লোকজন যখন প্রতিবাদ করে, তখন কি সাম্প্রদায়িক বলে কেউ?
বাংলাদেশের যেহেতু ভারতের বা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ভূমিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে; যেমন সীমান্ত হত্যা, পানি আটকে রাখা কিংবা কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া, বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা করা ইত্যাদি৷ বিজেপি তো সারাক্ষণই বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা করে৷ সেগুলোর কারণে ভারত রাষ্ট্রের বা সরকারের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, সেটা তো সাম্প্রদায়িকতা না, সেটা হচ্ছে একটা বৃহৎ রাষ্ট্র অন্যায় করছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেটা বামদলগুলো করেছে৷ এখন হেফাজতে ইসলাম যা করেছে, সেটার সাথে তো বামদলগুলো একমত না৷ কিন্তু বায়তুল মোকাররমসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা যে প্রতিবাদ করছিল, তখন তাদের উপর হামলা করার কারণে এটা আরও সহিংস রূপ নিয়েছে৷ এখন সরকার যেভাবে গুলি করে মানুষ মেরেছে, তাদের মধ্যে অনেকে আছে যারা হেফাজতের লোকও না, সাধারণ কর্মজীবী মানুষ৷
এই খুন তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না৷ একটা প্রতিবাদ যদি ভুলও হয়, তার জন্য তাকে গুলি করে মারা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না৷ মোদী বিরোধী আন্দোলনের দুইটা দিক, একটা হচ্ছে বাম সংগঠনগুলো করেছে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে ভারত যে সমস্ত অন্যায়গুলো করে, বিশেষত সীমান্ত হত্যা এবং তিস্তার পানি বন্টনের সমস্যা এই দুটো বিষয় সামনে ছিল৷ আর হেফাজতের প্রতিবাদের বিষয়বস্তু ছিল ভারতে মুসলমানদের হত্যার যে অভিযোগ, সে অভিযোগটা ছিল৷ এই দুটি আন্দোলনই মোদীর বিরুদ্ধে হলেও সমন্বিত আন্দোলন একে বলা যাবে না, কারণ এটা উভয়ের ঐক্যবদ্ধ কোনো আন্দোলন ছিল না৷ মোদীর বিরুদ্ধে আন্দোলন তো বিভিন্ন এঙ্গেলেও হতে পারে৷ কাজেই এটা সমন্বিত কোনো আন্দোলন না৷ তবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যদি মোদীর বিরোধিতা হয়, সেটা মোদীর জন্য লাভজনক৷ কারণ, মোদীর শক্তি বৃদ্ধি মানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধি, কারণ এটা রিঅ্যাকশন হিসাবে হয়৷ আবার এইখানে যত সাম্প্রদায়িকভাবে মোদীর বিরোধিতা হবে, তত মোদীর লাভ৷ কারণ ঐখানে সাম্প্রদায়িক শক্তি যারা হিন্দু আছে, তারা এইখান থেকে জোর পায়৷
এই আন্দোলনটা মোদীর জন্য খুব কাজে লেগেছে যে মোদী এখন ভোটের ক্ষেত্রে সেটাকে ব্যবহার করবে এই বলে যে, যদি আমাকে সাপোর্ট করো তাইলেই আমিই কেবল মুসলমানদের দমন করতে পারব৷
পুরো ঘটনাবলি সরকার যেভাবে ডিল করেছে, তাতে তিনটা গোষ্ঠীর লাভ হয়েছে৷ প্রথমত হেফাজতে ইসলাম, যারা একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তাদের শক্তি জানান দিতে পেরেছে৷ এখানে সরকারেরও পরোক্ষ সমর্থনও ছিল৷ অনেক জায়গায় তারা ভাংচুর করেছে কিন্তু প্রশাসন কিছুই করেনি৷ দ্বিতীয়ত, লাভ সরকারের, তারা তাদের সমর্থকদের কাছে এটা দেখাতে পেরেছে যে, এই ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হচ্ছে, সুতরাং আমি ছাড়া কোনো বিকল্প নাই৷ তৃতীয়ত, লাভ হয়েছে বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদীর৷ তারা এই বিষয়টাকে ভোটের কাজে লাগাতে পারবে৷ সুতরাং বিগত কয়েকদিনের ঘটনায় লাভবান হয়েছে এই তিন গোষ্ঠী আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি, সাধারণ মানুষের স্বার্থ, দেশের ভাবমূর্তি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ৷
অনুলিখন: মর্তূজা রাশেদ