আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি নগরী বার্লিন
২ নভেম্বর ২০১০নানা দেশের শিল্পীদের আকৃষ্ট করছে বার্লিন
বিশ্বের নামিদামি শিল্পী ও গ্যালারিস্টরাই যে শুধু বার্লিনে এসে শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন তাই নয়, অনেক নাম না জানা শিল্পীও বার্লিনের আকর্ষণকে এড়াতে পারছেননা৷ মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে তুলছেন নগরীর সাংস্কৃতিক জগতকে৷ বিশেষ করে বার্লিনের নয়কোলন অঞ্চলেই নানা দেশ থেকে আসা শিল্পীদের সমাগমটা বেশি৷ বেকারত্বের উঁচু হার, অভিবাসীদের সংখ্যাধিক্য, তরুণ গ্যাংদের সহিসংসতা ইত্যাদি কারণে নয়কোলনের একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি বেশ কয়েক বছর ধরে৷ অন্যদিকে এই অঞ্চলকেই বেছে নিয়েছেন অনেক শিল্পী ও সংস্কৃতিমনা মানুষ তাঁদের সৃষ্টিকর্মের জন্য৷ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন পানশালা, গ্যালারি, ও আর্ট স্টুডিও খোলা হচ্ছে সেখানে৷ নয়কোলনে এখন জেগে উঠছে শিল্পের সুষমা নিয়ে প্রাণবন্ত এক বার্লিন৷
বার্লিনে খুঁজে পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক এক পরিবেশ
ফ্রান্স থেকে আসা ২৬ বছর বয়স্ক গিয়োম এরিও তাঁর কাঠের ভাস্কর্যটি দেখিয়ে বলেন, ‘‘আমি এখানে নিজেকে মুক্ত মনে করি৷ এখানে নানা ধরনের জিনিস তৈরি করার অনেক সুযোগ রয়েছে৷ পরিবেশটাও খুব ভাল, আন্তর্জাতিক৷ নানা জায়গার মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় এখানে৷ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, যা আমি খুব পছন্দ করি৷''
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চশিক্ষা কর্মসূচি ‘এরাসমুস'এর বৃত্তি নিয়ে বার্লিনে এসেছিলেন এরিও কয়েক বছর আগে৷ শহরটি তাঁর এত ভাল লেগে যায় যে, থেকেই যান সেখানে৷ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে নয়কোলনের এক আর্ট স্টুডিও ভবনে বসবাস শুরু করেন৷ এখানকার শিল্পীদের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক আছে, যার মাধ্যমে তাঁরা সবাই মিলে নানা রকম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন৷ এরিও বলেন, ‘‘আমি ফরাসি৷ একজন ইংরেজ, একজন জার্মান, একজন ইটালিয়ান আছেন আমার সঙ্গে৷ এখন আবার একজন ইরাকিও এসেছেন৷''
এই শিল্পীদের একজন ক্রিস্টোফার সেজ৷ তিনি লন্ডন থেকে এসেছেন৷ তাঁর মা বাবা প্রায়ই বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের অতিথি হিসাবে জায়গা দেন৷ এই আন্তর্জাতিক পরিবেশটা তাঁর বার্লিনে এসেও ভাল লেগেছে৷ ৭ বছর ধরে তিনি বসবাস করছেন বার্লিনে এবং দেখেছেন নয়কোলনের পরিবর্তন৷ ক্রিস্টোফার জানান, ‘‘এটা লক্ষণীয়, কত দ্রুত শিল্প ও সংস্কৃতি পাখা মেলছে আমার এলাকায়, কত মানুষ এখানে এসে বসবাস শুরু করেছেন৷ রাস্তাঘাটে জার্মান ও তুর্কি ভাষার পাশাপাশি এখন স্প্যানিশ ও ইংরেজিও শোনা যায়৷'' তবে ক্রিস্টোফারকে শুধু বার্লিনের আন্তর্জাতিক আমেজটাই আকৃষ্ট করেনা৷ শিল্পী হিসাবে তাঁর কিছু কিছু বিষয় নজরে পড়েছে, যেমনটি অন্য কোথাও দেখা যায়না৷ ক্রিস্টোফার জানান, ‘‘বার্লিনের বিশেষত্ব হল, এই শহরের ইতিহাস৷ মাঝে মাঝে স্থাপত্য নিয়ে বিতর্কেও উঠে আসে বিষয়টি৷ কোন ভবন নির্মাণ করা হবে, কোনগুলো ভেঙে ফেলা হবে, তা নিয়ে বেশ মাথা ঘামায় এখানকার মানুষ৷ শিল্পী হিসাবে স্থাপত্যও রাস্তাঘাটের আঁকাবাঁকা রেখা, আকাশের অবয়ব আকৃষ্ট করে আমাকে৷ এর মধ্যে যে আমি আঁকতে পারছি, এটা সত্যি দারুণ৷''
বিশেষ করে ডেনিশ শিল্পীদের টানছে বার্লিন
ডেনমার্কের আলোকচিত্রশিল্পী পের্নিলে কোল্ডবেখ এখন জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত৷ এক প্রতিষ্ঠানের বৃত্তি নিয়ে এসেছিলেন তিনি বার্লিনে৷ মেয়াদ শেষ হবার পর এখন যাওয়ার পালা৷ ছাড়তে হবে শিল্পীদের ভবনটিও৷ কিন্তু পের্নিলে বার্লিনে থাকতে চান৷ এই শহরেই তাঁর কাজটি যেন প্রাণ পেয়েছে৷ বিশাল আকারের ছবিগুলি এখন অন্য এক আর্ট স্টুডিওতে রাখতে হবে৷ পের্নিলে বলেন, ‘‘এটা সত্যি আনন্দদায়ক যে, এখানে নানা রকম মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়৷ আমার মনে হয়, বার্লিনের ইতিহাসই এর কারণ৷ অনেকে এসেছেন পূর্ব ইউরোপ থেকে৷ কিন্তু তাঁরা আবার এক জায়গা থেকে আসেননি৷ কোপেনহেগেনের রাস্তায় মানুষজনদের একই রকম লাগে৷ এখানে একেবারে আলাদা৷ বার্লিনের যে কোনো প্রান্তেই আমি এমন সব লোকজন খুঁজে পাই, যাদের নিয়ে আলোকচিত্রশিল্পী হিসাবে কাজ করতে আমার ভাল লাগে৷''
পের্নিলের মত ডেনমার্কের আরো বহু শিল্পী থিতু হয়েছেন বার্লিনে৷ ডেনমার্কের গোপন রাজধানীও বলা হয় বার্লিনকে৷ খ্যাতনামা ডেনিশ শিল্পী ওলাফুর এলিয়াসনও বসবাস করেন বার্লিনে৷ এই তো কিছুদিন আগে তাঁর এক প্রদর্শনী হয়ে গেল, যাতে বার্লিনকে নানাভাবে তুলে ধরেছেন এই শিল্পী৷ পের্নিলে কোল্ডবেখ বলেন, ‘‘এই শহরের পরিবর্তন হচ্ছে অনবরত৷ পাঁচ বছর পর কী রকম হবে, তা এখনই বলা যায় না৷ এই ধরনের গতিময়তা শুধু নিউইয়র্কেই দেখা যায়৷ কিন্তু বার্লিনে এক ধরনের উষ্ণতা, প্রশান্তির আমেজ রয়েছে৷ বেগবান কিন্তু অস্থির নয়৷ এই মিশ্রণটাই বার্লিনকে দিয়েছে বিশেষত্ব৷''
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন