আক্রান্ত সুন্দরগঞ্জ
১৮ মার্চ ২০১৩জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির রায় ঘোষণা করার পর দেশের বেশ কিছু জায়গায় ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা৷ তাণ্ডবের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখেছে সম্ভবত গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা৷
সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট তো সেখানে পুড়ে ছাই হয়েছেই, সরকারি সম্পদ বাদ যায়নি, প্রাণ গেছে ৪ পুলিশ সদস্যের, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী জামায়াত-শিবিরের কর্মী মারা গেছে তার চেয়েও বেশি৷ ১০-১৫ হাজার উন্মত্ত মানুষ কীভাবে হামলা চালিয়েছিল, তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাত্র ১০-১৫ জন পুলিশ কী অবস্থায় গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়েছিল সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়ে গত ৬ই মার্চ তা জানিয়েছিল ডয়চে ভেলে৷
এবার কথা হলো সংগীত শিল্পী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজা বেগম কাকলির সঙ্গে৷ এমন একজনের সঙ্গে কথা বলার প্রধান কারণ হামলার ক্ষয়ক্ষতি এবং তার পরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা নেয়া৷ সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে জানা গেল কাকলির স্বামী আহসানুল করিম চাঁদও সংগীত শিল্পী৷ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিতে তিনিও সক্রিয়৷ বাংলাদেশে একটা ধারণা খুব প্রচলিত৷ সরকারি দল করলে নাকি খুব সুবিধা৷ নেতা-নেত্রী হলে তো কথাই নেই! হাফিজা বেগম কাকলির অভিজ্ঞতা অবশ্য তা একেবারেই বলছেনা৷ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার পরও জামায়াত-শিবিরের হামলায় যেখানে তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির প্রায় সবই শেষ, সেখানে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তা তো এই সাক্ষাৎকার শুনেই অনুমান করা সম্ভব৷
জামায়াত-শিবির হামলা চালিয়েছে নির্বিচারে৷ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেই তাঁর ওপর হামলা চালাতে হবে- দেশের রাজনীতিতে অতীতে এমন নজীর দেখা গেলেও গাইবান্ধায় জামায়াত এবার বেছে বেছে শুধু প্রতিপক্ষককেই মারেনি, পোড়ানোর সময় বাদ দেয়নি মুটে-মজুর-রিক্সাচালক, পান দোকানদার, বিত্তবান, হিন্দু-মুসলিম কাউকেই৷ বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কয়েক হাজার লোক এক হয়ে অপ্রস্তুত, নিরস্ত্র মানুষদের ওপর হামলা চালাচ্ছে- এমনটিও বাংলাদেশ আগে কি দেখেছে কখনো?
বাঁশখালি, কানসাট, নন্দিগ্রামসহ দেশের অনেকগুলো জায়গার মতো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জও দেখেছে এবার৷ কাকলি দেখেছেন ঘরের সব আসবাবপত্রের মতো শো-কেসটা শেষ, তার ওপরে সযত্নে রাখা কুরআন শরীফেরও অনেকটাই পুড়ে ছাই৷ স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময় ধর্ষণ, লুটপাট, হত্যা, নির্যাতনের অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির রায় দেয়া হলো ঢাকায়, কাকলির মতো কমপক্ষে দু'শ পরিবারের সর্বস্ব গেল সুন্দরগঞ্জে৷ উন্মত্ততার আগুন ধর্মগ্রন্থ চিনলোনা, রাখলোনা কাকলির হারমোনিয়াম-তবলা, তানপুরা, এমনকি ১৬ মাস বয়সের শিশু সন্তানকে যে ফিডারে দুধ খাওয়াবেন সে উপায়ও ছিলনা৷ স্বামীর মাত্র তিন মাস আগে কিস্তিতে কেনা মোটর সাইকেলটা গেছে পুড়ে, বাড়ির বাইরের সব গাছ উপড়ে ফেলায় তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার আজ আক্ষরিক অর্থেই ধংসস্তুপ৷
এতদিন সেই ধ্বসস্তুপ থেকে দূরেই ছিলেন কাকলি৷ আত্মীয়ের বাসায় আর কতদিন থাকা যায়! দুদিন আগেই ফিরেছেন নিজের বাড়িতে৷ সংসার গোছানো শুরু করেছেন আবার শূন্য থেকে৷ তা-ও করতে হয়েছে আতঙ্ক নিয়ে৷ এখনো হুমকি দিয়ে যাচ্ছে জামায়াত শিবির৷ কাকলি বললেন, এবার হামলা চালালে জীবিত রাখা হবেনা- এ কথাও নাকি জানিয়ে দিয়েছে হুমকিদাতারা৷ পুলিশ তেমন কিছু করতে পারছেনা৷ প্রথম কারণ, অপর্যাপ্ত জনবল৷ তাছাড়া জামায়াত-শিবির হুমকি দিচ্ছে চরাঞ্চল থেকে, সংঘবদ্ধ একটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানে গিয়ে অভিযান চালানোয় এমন কিছু ঝুঁকি রয়েছে যা এড়িয়ে এ মুহূর্তেই কিছু করতে যাওয়া ঠিক মনে করছেনা পুলিশ৷ তাই সুন্দরগঞ্জবাসীর এখনো আতঙ্কের মাঝেই বসবাস৷ জামায়াত-শিবিরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারের তরফ থেকে বলার মতো কোনো সাহায্য-সহযোগিতা এখনো পাননি৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হাফিজা বেগম জানালেন, হামলায় পুড়ে যাওয়া কিছু দোকানের জন্য নাকি মাত্র এক হাজার টাকা করে পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা!