কিশোরী বিবাহ ‘বৈধ’ করার উদ্যোগ
৪ অক্টোবর ২০১৪স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মনে করছেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করার চিন্তা হালে পানি পাচ্ছে৷ তবে বাস্তবে বাংলাদেশের নারী সমাজ, সুশীল সমাজ বা পরিসংখ্যানের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না এই উদ্যোগ৷ আর চিকিত্সা বিজ্ঞানও ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে বা মা হওয়াকে ক্ষতিকর বলেই রায় দিয়েছে বহু আগে৷
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন আরো কঠোর করা হচ্ছে৷ গত ১৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভা নতুন আইনের খসড়াও অনুমোদন করেছে৷ এই আইনে বাল্যবিবাহের অপরাধ প্রমাণিত হলে ২ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে৷ এখনকার প্রচলিত আইনে ১ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে৷ প্রস্তাবিত আইনে আগের মতই ১৮ বছরের আগে নারীদের বিয়ে নিষিদ্ধ আছে আর পুরুষের ২১৷ তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ বছর করার কথাও উঠেছে৷ এর কারণ তখন বলা না হলেও গত বৃহস্পতিবার এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক৷
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন,‘‘মেয়েরা নানা প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছে৷ তাদের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে, আকছার ঘটছে এসব ঘটনা৷ এটা বাস্তবতা৷''
মালেক দাবি করেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর তাই বিয়ের বয়স কমানোর জন্য মারাত্মক চাপ রয়েছে৷''
এখানে আরেকটি বিষয় দেখা প্রয়োজন৷ ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে৷ অর্থাৎ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্য বিবাহের শিকার হয়৷ সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর ২০১০ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে৷
প্রতিবেদন দু'টিতে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত নারীদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে ধরা হয়েছে৷ তাই বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার অনেক বেশি বলে প্রতীয়মান হয়েছে৷ এখন বয়স কমিয়ে যদি ১৬ বছর করা হয় তাহলে এই পরিসংখ্যান পাল্টে যাবে৷ বাল্যবিবাহ প্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থার হয়তো উন্নতি ঘটবে কাগজে কলমে৷ এতে সরকারের লাভ৷
প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে কি হবে? বাস্তবে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে৷ মায়েদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে৷ বাড়বে শিশু ও মায়ের মৃত্যুর হার৷ গবেষকরা বলছেন, বাল্যবিবাহের শিকার শতকরা ৮০ ভাগ নারীরা স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত হচ্ছেন৷ এছাড়া এসব নারীর শতকরা ৬০ ভাগ শিশু জন্মগত নানাবিধ রোগ ও প্রতিবন্ধিতার শিকার হচ্ছে৷
বাংলাদেশে বর্তমানে ৬৬ শতাংশের এক তৃতীয়াংশ মা ১৯ বছরের হওয়ার আগেই গর্ভবতী হচ্ছেন৷ নারী ও শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা মনে করেন, ১৮ বছরের আগে একটি মেয়ের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পূর্ণতা পায়না৷ এজন্য ১৮ বছর পর্যন্ত একটি মেয়েকে শিশু বা কিশোরী বলা যায়৷ বাল্য বিয়ে ও মাতৃত্ব একই সাথে অনেকগুলো সমস্যা সৃষ্টি করে সমাজকে জটিল করে তুলছে ৷
বিষয়টি নিয়ে আমি কয়েকজন মানবাধিকার ও নারী নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি৷ তারা মনে করেন, বাল্যবিবাহ নিরোধে কঠোর শাস্তির প্রস্তাবের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে যদি ১৬ বছর করা হয় তাহলে নতুন আইনটি কোন ফল দেবেনা৷ উল্টো আইনেই বাল্যবিবাহের সুযোগ সৃষ্টি হবে৷ আর তাতে নারীরা শিক্ষাসহ নানা উন্নয়নে পিছিয়ে পড়বে৷ তাদের প্রশ্ন: সারাবিশ্ব যেখানে সামনে হাঁটছে আমরা কি সেখানে পিছনে হাঁটব?
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের নীচের সকল মানবই শিশু৷ তাহলে বাংলাদেশ কী এই সনদ মানবে না? মেয়েদের বয়স কমিয়ে ১৬ বছর করে কী শিশুর সংজ্ঞাই পাল্টে দেবে! আর সেই সংজ্ঞা পাল্টে বাল্য বিবাহ কম দেখানো হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কি গ্রহণযোগ্য হবে?
ফিরে আসি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কথায়৷ তিনি কিভাবে জানলেন অল্পবয়সের মেয়েরা আকছার পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে? আমার পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছি, তাদের কাছে যেসব অভিযোগ আসে তার অধিকাংশই জোর করে বাল্যবিবাহের৷ এরজন্য দায়ী অভিভাবকরা এবং বিয়ের কাজি৷ তবে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নিজেদের বিয়ে করার উদাহরণও আছে৷ সেক্ষেত্রে ফয়সালা করার জন্য আদালত আছে৷ বয়স কমিয়ে সুযোগ করে দিতে হবে কেন?
আমি মনে করি স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মেয়েদের এককভাবে দায়ী করে পুরষ শাসিত সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন৷ আর এভাবে বয়স কমানোর পেছনে কোন সৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না৷ তাই সরকারের উচিত হবে এধরনের চিন্তা থেকে সরে আসা৷