অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত জনজাতি
২৩ এপ্রিল ২০১৯আদিবাসীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের চিরাচরিত অরণ্যের অধিকার থেকে৷ তাঁদের বাসভূমি থেকে৷ তাদের জীবন ও জীবিকা থেকে৷
ভারতে মোট বনভূমির আয়তন সাত লক্ষ বিরাশি হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি৷ গোটা দেশের মোট এলাকার প্রায় ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশ৷ ঔপনিবেশিক শাসনকালে নিজেদের আর্থিক প্রয়োজন পূরণে নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করে বনসম্পদ কাজে লাগানো হতো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে৷ ফলে উপজাতি সম্প্রদায় এবং অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায়, যাঁরা পরিবেশ এবং বনাঞ্চলের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত, যাঁরা ইকো-সিস্টেমকে অটুট রেখে আসছেন বংশপরম্পরায়, তাঁরা রয়ে গেছেন প্রান্তিক, হয়েছেন বঞ্চনার শিকার৷ স্বাধীনতার পরেও কিন্ত অবস্থার ইতরবিশেষ হয়নি৷ বনসৃজন যা হয়েছে, বাণিজ্যিক স্বার্থে বনভূমি ধ্বংস হয়েছে তার বেশি৷ বন কেটে বসত তৈরি হয়েছে অনেক বেশি৷ খনি ও শিল্প কারখানা ক্রমশই গ্রাস করে নিচ্ছে বনাঞ্চলকে৷
তবে বনভূমিতে জনজাতিদের বসবাসের মোটামুটি একটা স্বীকৃতি প্রথম দেওয়া হয় ১৯৮৮ সালে৷ বলা হয়, উপজাতির লোকেরা অরণ্যভূমি রক্ষা করেন, জমির উর্বরতাশক্তি বাড়ান৷
অবশেষে ২০০৬ সালে অরণ্য আইন সংশোধন করা হয়৷ সংশোধনীতে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বনভূমি রক্ষা করা এবং আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা হয়৷ গ্রামসভাগুলিকে অরণ্যভূমি রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ উপজাতি বা জনজাতিদের মামুলি বনজ সম্পদ সংগ্রহ এবং পরিবহনের অনুমতি দেবার ক্ষমতা দেওয়া হয় গ্রামসভাগুলির নির্বাচিত কমিটির হাতে৷
কিন্তু বাদ সেধেছে সুপ্রিম কোর্টের রায়৷ অরণ্যভূমি থেকে আদিবাসীদের উত্খাত না করার আবেদন খারিজ হয়ে যায় শীর্ষ আদালতে৷ সতেরোটি রাজ্যের আদিবাসীদের উৎখাতের শেষ সময়সীমা ধার্য করা হয়েছে এই বছরের ২৪শে জুলাই৷ পুলিশ ও প্রশাসন যদি সেই সময়সীমা পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে উচ্চতম আদালত আরো কঠোর হবে৷ সরকারের তরফে এক হলফনামা দিয়ে বলা হয়, যে-সব রাজ্যে উগ্র বামপন্থিদের দৌরাত্ম বেশি, সেখানে এই নির্দেশ কার্যকর করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে৷ আদিবাসী ও জনজাতির মানুষজন গরিব ও নিরক্ষর৷ বাস করে বনভূমির প্রান্তিক অঞ্চলে৷ আইন-কানুন ও মালিকানার প্রকৃত অর্থ ঠিক বোঝে না৷ জমির পাট্টা কী জানে না৷ গ্রামসভাগুলিকে তাঁদের এ বিষয়ে সাহায্য করতে বলা হয়েছে৷ কুড়িটি এনজিও আদালতের নির্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছে, এই নির্দেশ কার্যকর করতে গেলে ২০০২ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে৷ পুনর্বাসন ছাড়াই অরণ্য বিভাগের উচ্চতম আধিকারিকের নির্দেশে জনজাতিদের উৎখাতের জন্য তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ বিকাশের বদলে তাঁদের জীবন ও জীবিকায় বেজেছিল মৃত্যুঘণ্টা৷ মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাংসদ বৃন্দা কারাত প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, যাঁরা আজন্ম অরণ্যলালিত, তাঁদের উৎখাত বন্ধ করতে যেন অবিলম্বে অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়, না হলে সেটা হবে জনজাতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর৷
একদিকে অরণ্য আইন ও আদিবাসীদের জীবন ও জীবিকা, অন্যদিকে বাণিজ্যিক স্বার্থের সংঘাত৷ এই প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ অধ্যাপক তুহিন ঘোষের অভিমত জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘খনি সম্পদের কথা বাদ দিলেও পর্যটন শিল্পের কথা ধরুন. বনভূমিতে নিত্যনতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠছে৷ সব সময় নিয়ম-কানুন মেনে যে হচ্ছে, তা নয়৷ যেখানে জমি কব্জা করতে পারছে, সেখানেই হচ্ছে ট্যুরিস্ট লজ, রিসর্ট, হোটেল৷ মোদ্দা কথা, বিনিয়োগ৷ কাজেই প্রতিযোগিতাই সারকথা৷ খনির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে৷ বিভিন্ন খনিজ সম্পদের ভান্ডার এই বনাঞ্চল৷ সেই বনাঞ্চল আমরা বিসর্জন দেব কি দেব না, সেটার জন্য আয়-ব্যয়ের একটা হিসেব মাথায় রাখতে হয়৷ সেই রেশিওটা উন্নত দেশে এক রকম, আমাদের দেশে এক রকম৷ কিন্তু আদিবাসীদের কথা কেউ ভাবে না৷ তাঁরা চিরদিনই থেকে যায় উপেক্ষিত৷''
এই প্রসঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করলেন মধ্যপ্রদেশের একটা ছোট জনজাতি গোষ্ঠীর কথা৷ সংখ্যায় তাঁরা ১০০ জনের মতো৷ সরকারি আধিকারিকরা মনে করলেন, এদের যাপিত জীবন, সংস্কৃতি, রীতিনীতি অসভ্য৷ এটা চলতে দেওয়া যায় না৷ বন্ধ করার চার বছরের মাথায় এই সংখ্যাটা কমে দাঁড়ালো এক-চতুর্থাংশে৷ বলা ভালো, মরে গেল৷ ‘‘ওদের লোকসংস্কৃতি ছিল ওদের ধ্যান,জ্ঞান, জীবন৷ সেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারটা ধ্বংস করা অন্যায়৷ ওদের জীবন ও জীবিকা বনসম্পদের ওপর নির্ভরশীল৷ ওদের বনভূমি থেকে উৎখাত করলে বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন মানুষ সেই সম্পদকে ছিনিয়ে নেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ আদিবাসী ও জনজাতিদের সামাজিক ন্যায়বিচার বা তাঁদের মানবাধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না৷'' বলেন তুহিন ঘোষ৷
অধ্যাপক তুহিন ঘোষ কর্মসূত্রে সুন্দরবন এলাকায় যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘সেখানকার যেসব আদি বাসিন্দা ওখানকার জমি তৈরি করেছে, জমিকে উর্বর করেছে, স্বচক্ষে দেখেছি তাঁদের অবস্থা কী করুণ৷ তাঁরা এখন একঘরে, কোণঠাসা৷ লোধা, শবর জনজাতি গোষ্ঠী সমাজ থেকে তাঁরা যেন বিচ্ছিন্ন৷ দারিদ্র্য তাঁদের নিত্যসঙ্গী৷ অরণ্যে যাঁরা দীর্ঘদিন বাস করছে, তাঁরাই অরণ্যের প্রকৃত রক্ষক৷ তাঁদেরই থাকা উচিত অরণ্যের অধিকার৷ কিন্তু সরকারে কোনো হেলদোল নেই৷ পাশাপাশি কাঠব্যাবসায়ীদের হাত থেকে বৃক্ষ নিধন আটকাতে ভারতেই ১৯৮১-৮২ সালে শুরু হয় এক অভিনব আন্দোলন৷ নাম চিপকো আন্দোলন৷ শুরু হয় হিমালয় রাজ্য উত্তরাখন্ডের চামোলিতে৷ অগ্রণী ভূমিকা নেয় মহিলারা৷ গাছ কাটার খবর জানতে পারলে তাঁরা ছুটে গিয়ে গাছকে জড়িয়ে ধরে৷ এই চিপকে ধরা থেকেই নাম হয়েছে চিপকো আন্দোলন৷ এর প্রাণপুরুষ সুন্দরলাল বহুগুণা পাঁচ হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা করে এই আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেন৷''