অরগ্যানিক পণ্য নিয়ে সংশয় কাটাবে কে?
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭২০০৩ সালে আব্দুস সালামের জীবনে একটি সুযোগ আসে৷ তিনি নরওয়েতে অরগ্যানিক বরবটি রপ্তানির সুযোগ পান৷ নরওয়ের ক্রেতা বলেছিল, বরবটি এক ইঞ্চি করে কেটে প্যাকেটজাত করে ফ্রোজেন ভেজিটেবল হিসেবে পাঠাতে হবে৷ সব প্রস্তুতির পরও তাঁর আশা এবং উৎসাহে পানি ঢেলে দেয় বাংলাদেশের নিয়ম৷ এখানে অরগ্যানিক ফুডের কোনো সার্টিফিকেশন বডি নেই৷ কিন্তু নরওয়ের ঐ ক্রেতা সার্টিফিকেশন ছাড়া বরবটি নেবেন না৷ তারপরও হাল ছাড়েননি আব্দুস সালাম৷ চেষ্টা করেন বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে সার্টিফিকেশন নিতে৷ যোগাযোগ করে দেখেন মুম্বই থেকে বিশেষজ্ঞ ঢাকায় এনে এই অরগ্যানিক সার্টিফিকেট নিতে সে সময় খরচ হতো সাড়ে ছয় লাখ টাকা৷ লাভ-লোকসান হিসেব করে তাই সেবার আর নরওয়েতে অরগ্যানিক বরবটি রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে৷
কিন্তু এরপরও তিনি অরগ্যানিক খাদ্য উৎপাদন থেকে সরে যাননি৷ বরং সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন৷ গড়ে তোলেন বাংলাদেশ অরগ্যানিক প্রোডক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিওপিএমএ)৷ এরইমধ্যে তারা সরকারের মাধ্যমে অরগ্যানিক ফুড পলিসি করাতে সক্ষম হয়েছেন৷ আশা করছেন, সার্টিফিকেশন বোর্ডও হয়ে যাবে অচিরেই৷
বিওপিএমএ-র সভাপতিও আব্দুস সালাম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন অন্তত ৭০টি বৃহৎ কৃষি ফার্ম আছে, যারা অরগ্যানিক ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করে৷ এছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে কয়েক হাজার চাষী এ মুহূর্তে অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত৷''
তিনি জানান, ‘‘শাক-সবজি, মাছ-মাংস-ডিম-ফল সবই এখন অরগ্যানিক উৎপাদনের আওতায় এসেছে৷ কিন্তু এর দাম বেশি৷ সে কারণেই মানুষের আগ্রহ কম৷ আর সার্টিফিকেশনের সুবিধা না থাকায় রপ্তানির সুবিধাও কম৷ তাই প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) পণ্যের সঙ্গে৷''
তাঁর দাবি, ‘‘এরপরও বাংলাদেশের মোট কৃষি এবং কৃষিপণ্যের ১০-১২ ভাগ অরগ্যানিক৷'' তিনি জানান, ‘‘কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ছাড়া জৈব সার এবং জৈব কীটনাশক দিয়ে এ সমস্ত অরগ্যানিক পণ্য উৎপাদন করা হয়, যা সুস্থ শরীরের জন্য অপরিহার্য৷''
অরগ্যানিক চাষাবাদের সমস্যা হচ্ছে, জৈব সার ও জৈব কীটনাশকের অভাব৷ আগে এটা উৎপাদনের বাধা ছিল৷ কিন্তু সেই বাধা দূর হয়েছে৷ এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাগেরহাটের ফকিরহাটে বেতাগা অরগ্যানিক পল্লি৷ ২০১৩ সালে কয়েকজন কৃষককে সমবেত করে মাত্র ২৫ একর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ শুরু করেন ঐ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান স্বপন দাস৷ এখন সেখানে ১০০ একর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হচ্ছে৷ ৭০ জন কৃষক কাজ করছেন সেখানে৷ আরো অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন৷ স্বপন দাস ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা মূলত কৃষকদের অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি৷ তাঁদের জন্য জৈব সার উৎপাদন করছি৷ জৈব সার উৎপাদনের একাধিক প্ল্যান্ট করেছি আমরা৷ আমাদের এসব কাজে সার্বক্ষণিক সহায়তা করছে স্থানীয় কৃষি অফিস৷''
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই লাউ, ঝিঙে, পটল, উচ্ছে, করলা, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক, শসা, চিচিঙ্গা, শসা, বেগুন, আলু, টমেটো, সূর্যমুখী, থাইপেয়ারা ও মাল্টার চাষ হচ্ছে সেখানে৷ গবাদি পশু পালন হচ্ছে৷ অরগ্যানিক দুধ আসছে ঢাকার বাজারেও৷ শুরু হবে মৎস চাষ৷ এইসব অরগ্যানিক পণ্য বাজারজাত করার জন্য আলাদা একটি বাজারও স্থাপন করা হয়েছে৷ কৃষকদের পরামর্শ দিতে স্থাপন করা হয়েছে কৃষি ও তথ্য সার্ভিস সেন্টার৷
স্বপন দাস জানান, ‘‘নেপালের কাঠমান্ডুর অরগ্যানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এখানে পরিবেশবান্ধব শাক-সবজির আবাদ করা হচ্ছে৷ আমি ইউরোপের কয়েকটি দেশ এবং ভারতে অরগ্যানিক চাষাবাদ দেখে উদ্বুদ্ধ হই৷ আমি চেয়েছি সবাই যেন এতে উদ্বুদ্ধ হয়৷ তাই সবাইকে নিয়ে কাজ করছি৷ এতে একদিকে যেমন কীটনাশক থেকে পরিবেশ রক্ষা পাচ্ছে, অপরদিকে স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে৷''
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ অরগ্যানিক এগ্রিকালচারাল মুভমেন্ট-এর (আইএফওএএম) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩৪টি এনজিও তাদের সদস্য৷ এর মধ্যে ৪৭টি এনজিও সরাসরি অরগ্যানিক কৃষিকাজ করে৷ ৮৭টি টেকসই কৃষি নিয়ে কাজ করে এবং তিনটি কৃষি সংক্রান্ত অ্যাডভোকেসির সঙ্গে জড়িত৷
তাঁদের মতে, বাংলাদেশে মোট ০ দশমিক ১৭৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে অরগ্যানিক চাষাবাদ হয়, যা মোট চাষযোগ্য জমির শতকরা ২ ভাগ৷ প্রশিকা এই অরগ্যানিক চাষাবাদে সবচেয়ে এগিয়ে৷
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. গোলাম মারুফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা অরগ্যানিক কৃষিকে উৎসাহিত করি৷ তবে এ নিয়ে আমাদের আলাদা কোনো শাখা নেই৷ আমাদের নীতি হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক যত কম ব্যবহার করা যায়৷ বিটি ব্রিঞ্জেল তারই উদাহরণ৷'' এছাড়া অরগ্যানিক পণ্যের সার্টিফিকেশন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, এটা একটা সমস্যা যে ক্রেতারা অরগ্যানিক কৃষি পণ্য চিনবেন কীভাবে? তারা কীভাবে নিশ্চিত হবেন? এ জন্য আমাদের কাজ চলছে৷ আমরা আশা করি, এই সার্টিফিকেশন এখানেও চালু হবে৷''
বাংলাদেশের অরগ্যানিক চা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে৷ পঞ্চগড়ের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের চা এখন নিয়মিত বিক্রি হয় লন্ডনের হ্যারড্স ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে৷ এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের প্রতিনিধি দল অরগ্যানিক চা চাষ পদ্ধতি সরোজমিনে পরিদর্শন করে এর কোয়ালিটি যাচাই করে তারপর এই চায়ের অর্ডার দেয়৷ এখানকার অরগ্যানিক চা চাষের বৈশিষ্ট্য হলো কোনো প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না৷ অরগ্যানিক চা চাষের জন্য এখানে গরুর একটি খামার গড়ে তোলা হয়েছে৷ খামারের জৈব সার ব্যবহার করে এখানে সাতটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট গড়ে উঠেছে৷ আর চা ভ্যালিতে ইপিল-ইপিল গাছ ব্যবহার না করে হারবাল ঔষধি গাছ শেড ট্রি হিসেবে ব্যবহার হয়৷ যেমন – নিম, হরিতকি, আমলকি, বহেরা, নিশিন্দা ,কাঞ্চন, অর্জুন প্রভৃতি৷
কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট ছাড়াও টিটিসিএল (তেঁতুলিয়া টি কর্পোরেশন লি.), স্যালিনা টি এস্টেট, করতোয়া টি এস্টেট, ডাহুক টি এস্টেটে অরগ্যানিক চা উৎপন্ন হচ্ছে৷
বাংলাদেশের আমও এখন ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে যাচ্ছে৷ এ সমস্ত আম অরগ্যানিক৷ এর পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া অরগ্যানিক কিনা, তা মনিটর করেন ক্রেতারাই৷ তাছাড়া এখন অরগ্যানিকভাবে মাছ, গবাদি পশু এবং হাস-মুরগির চাষও হচ্ছে৷ অরগ্যানিক ডিম, মাংস সহজেই পওয়া যাচ্ছে৷
ঢাকার বেশ কিছু চেইনশপ ছাড়াও অনেক ছোট ছোট দোকান গড়ে উঠেছে, যেখানে অরগ্যানিক কৃষিপণ্য বিক্রি হয়৷ তাদের কেউ কেউ নিজেরাই অরগ্যানিক শাক-সবজি উৎপাদন করেন৷ আবার কেউ কেউ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেন অরগ্যানিক চাষাবাদে৷
অরগ্যানিক চাষাবাদে উৎপাদন কিছুটা কম হয়৷খরচ একটু বেশি, তাই এর দামও একটু বেশি৷ কিন্তু বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার চাইলে একটু বেশি দাম দিতেই হবে বলে মনে করেন বিওপিএমএ-র আবুল কালাম আজাদ৷ তিনি বলেন, ‘‘অরগ্যানিক বিডি লিমিটেড নামে আউটলেটের মাধ্যমেও আমরা বিক্রি করি, আবার চেইন শপেও দেই৷ কিন্তু মানুষ এখনো অরগ্যানিক বলে বিশ্বাস করতে চায় না৷ এই বিশ্বাসের জন্য দরকার সার্টিফিকেশন৷ সার্টিফিকেশন অথরিটি হলে বাংলাদেশের অরগ্যানিক পণ্য দেশের বাইরে অনেক বড় বাজার পাবে৷''
বাংলাদেশ রিসার্চ সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ এবং কৃষকদের সহায়তা করে৷ তারা সাতক্ষীরা এলাকার ৪০টি গ্রাম এবং ২৩টি সংগঠনকে অরগ্যানিক চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে৷ তারা জৈব সার ও জৈব কীটনাশক তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়৷ ঐ এলকার কৃষরা এখন ব্যাপকভাবে সবজি, ফল, মাছ ও হাঁস-মুরগির চাষ করছেন অরগ্যানিক পদ্ধতিতে৷ বারসিক-এর প্রোগ্রাম অফিসার মননজয় মন্ডল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘স্থানীয় বাজারে কৃষকদের উৎপাদিত অরগ্যানিক পণ্য বিক্রি হয়৷ তাঁরা বিভিন্ন দোকানেও দেন, আবার আলাদাও বিক্রি করেন৷ হাটে অরগ্যানিক শাক-সবজির আলাদা জায়গা আছে৷ তবে কৃষকদের বাড়িতে গিয়েই সারাসরি ক্রেতারা বেশি কেনেন৷ দাম একটু বেশি হলেও ক্রেতারা ধীরে ধীরে অরগ্যানিক খাদ্যের দিকে ঝুঁকছেন৷''
অ্যাপোলো হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ড. তামান্না চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এক সময় সব কিছুই তো প্রাকৃতিকভাবে হতো৷ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদনই অরগ্যানিক৷ এখন উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে বা দ্রুত উৎপাদন করতে গিয়ে আমরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছি৷ কিন্তু আমাদের অরগ্যানিকেই ফিরতে হবে৷ কারণ, আমরা আমাদের শরীরকে বিষাক্ত করতে পারি না৷ এখন হয়ত অরগ্যানিকভাবে উৎপাদিত খাদ্যের দাম বেশি৷ কিন্তু শরীরের কথা চিন্তা করলে, পুষ্টির কথা চিন্তা করলে, এই বেশি দাম আমাদের দিতেই হবে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘সুসম পুষ্টির কথা চিন্তা করলে অরগ্যানিকের কোনো বিকল্প নেই৷ তাই ধীরে ধীরে মানুষ অরগ্যানিক খাদ্যের দিকে ঝুঁকছে৷ আর আমরাও অরগ্যানিক খাদ্যেরই পরামর্শ দিই৷''
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷