পোলিও রোগ মুক্ত
২৭ জানুয়ারি ২০১৪একেবারে দিন-তারিখের হিসেব করলে ফাঁড়াটা কাটল এই বছরের ১৩ জানুয়ারি৷ কারণ, ঠিক তিন বছর আগে, ২০১১ সালের এই ১৩ জানুয়ারি তারিখেই পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার পাঁচলা ব্লকের এক গ্রামে পাঁচ বছরের মেয়ে রুকসা শা-র ডান পায়ে পোলিও ধরা পড়েছিল৷ রুকসার বাবা আবদুল শা পাঁচলা ব্লকের আর পাঁচজনের মতোই জরির কাজ করেন৷ তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, সরকারি ঘোষণা, কাগজে-টিভিতে লাগাতার প্রচার সত্ত্বেও তিনি তাঁর মেয়েকে প্রতিবার পোলিও ভ্যাকসিনের ড্রপ খাওয়ানোর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি৷ হঠাতই যেদিন থেকে রুকসার পা রুগ্ন এবং কমজোরি হয়ে উঠতে শুরু করে, সেদিন তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, পোলিও রোগের সম্ভাব্য বিপদকে অবহেলা করা ভুল হয়েছিল৷
তবে সুখবর যেটা, নিয়মিত চিকিৎসার পর রুকসার এখন অনেকটাই রোগমুক্ত৷ তার ডান পা যদিও অন্য পায়ের তুলনায় একটু ছোট এবং একটু কমজোর৷ বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় বেশি দৌড়োদৌড়ি করলেও ডান পায়ে একটু ব্যথা করে, কিন্তু পোলিওর জীবাণু রুকসারকে আর কাবু করতে পারবে না৷ আর তার থেকেও বড় সুখবর, ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি রুকসারের পোলিও ধরা পড়ার ওই ঘটনাই ভারতে শেষ নথিভুক্ত পোলিও সংক্রমণের নজির৷ পরের তিন বছরে ভারতের আর কোথাও একটিও পোলিও সংক্রমণের ঘটনা জানা যায়নি৷ যদিও পোলিও সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ থেমে থাকেনি৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও এখন সেই তথ্যপঞ্জি পরীক্ষার কাজ শেষ করার পথে৷ সম্ভবত আগামী মাসেই ভারতকে সম্পূর্ণ পোলিওমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করবে ডাব্লিউএইচও৷ আর কেবল ভারতই নয়, এই সঙ্গে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই পোলিওমুক্ত অঞ্চল হয়ে উঠবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে যেটা অত্যন্ত শেষ আনন্দের খবর৷
তবে পোলিও রোগের বিরুদ্ধে সচেতনতা জারি রাখতে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় রবিবার যথারীতি পোলিও শিবির হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়৷ দক্ষিণ কলকাতার এ রকমই এক শিবিরে বসে ছিলেন ঝর্না মল্লিক৷ স্থানীয় এক বস্তির বাসিন্দা মধ্যবয়সিনী ঝর্না দিন চালান পরিচারিকার কাজ করে৷ স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পুরসভার স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদে ঝর্না এই সাপ্তাহিক শিবিরে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুক্ত৷ তিনি জানালেন, আসল কাজটা তাদের করতে হয় অঞ্চল বা পাড়া পর্যায়ে, লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে৷ বোঝাতে হয়, কেন পাঁচ বছরের নীচে সমস্ত বাচ্চার পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়াটা জরুরি৷ সমস্ত বাচ্চার নিঃশ্বাসের সঙ্গে পোলিও প্রতিষেধক বাতাসে মিশে কীভাবে এক সুরক্ষা বলয় তৈরি করছে, সেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বও তাঁদের সহজ কথায় বোঝাতে হয়৷ এই ঝর্নাই জানালেন, পোলিও প্রতিষেধক নিয়ে নানান ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে মানুষের মধ্যে৷ কখনও তার কারণ সামাজিক কুসংস্কার, অনেকক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাস৷ পোলিও-র বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার পাশাপাশি এ সবের বিরুদ্ধেও তাঁদের লড়তে হয়েছে৷
তবে ভারতে শেষ পোলিও সংক্রমণ তিন বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়লেও, পোলিও কর্মসূচি সবথেকে বেশি বাধা পেয়েছে বিহারে এবং উত্তর প্রদেশে৷ ফলে এই দুই রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের একটু বেশিই সতর্ক থাকতে হয়েছে৷ উত্তর প্রদেশে শেষ পোলিও রোগ ধরা পড়েছে ২০১০ সালের এপ্রিলে৷ আর বিহারে ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতি বছর অন্তত সাত বার পাঁচ বছরের নীচে সব বাচ্চাকে পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়েছে, যাতে আর একটি সংক্রমণের ঘটনাও না ঘটে৷ পাশাপাশি টিভি এবং খবরের কাগজে নিয়মিত পোলিও সচেতনতা প্রচার করা হয়েছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে৷ ভারতের চলচ্চিত্র জগতের আইকন অমিতাভ বচ্চনকে দেখা গিয়েছে সেই বিজ্ঞাপনে৷ অবশেষে সাফল্য এসেছে৷ এক উত্তর প্রদেশেই চার লক্ষ বাচ্চাকে পোলিও ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে৷ ২০০৯ সালে ওই রাজ্যে যেখানে ৬০২টি পোলিও ধরা পড়েছিল, পরের দু'বছরে সেই সংখ্যাটা শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে৷
পশ্চিমবঙ্গে প্রতি পালস পোলিও দিবসে ৯৭ লক্ষের বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সি বাচ্চাকে ওরাল ভ্যাকসিন খাওয়ানো গেলেও হাওড়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার কিছু অঞ্চলে এবং কলকাতার মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে পোলিও ভ্যাকসিন সম্পর্কে একটা প্রবল আপত্তি এবং বিরোধিতা ছিল৷ অনেক ভুল ধারণার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল, শৈশবে পোলিও ভ্যাকসিন খেলে প্রজনন ক্ষমতা লোপ পাবে! একটা চোরা প্রচার ছিল যে সরকার আসলে কৌশলে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে৷ কয়েকটি ক্ষেত্রে পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়ার পর শিশুমৃত্যুর ঘটনাও অপপ্রচারে ইন্ধন জুগিয়েছিল৷ যদিও সবকটি ক্ষেত্রেই ওই শিশুরা আগে থেকে অসুস্থ ছিল বলে পরে জানা যায়৷ সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তর, বিভিন্ন এনজিও এবং ইউনিসেফ-এর স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় পোলিও-মুক্তি ঘটল অবশেষে৷