সীমান্ত হত্যা বলতে পররাষ্টমন্ত্রীর সংশয়!
৭ জানুয়ারি ২০২১ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম এখানো আশায় বুক বেধে আছেন যে, মেয়ের হত্যার বিচার হবে৷ কিন্তু সে আশা কি পূরণ হবে?
পেটের দায়ে ভারতে গিয়েছিলেন মেয়েকে নিয়ে৷ দেশে এনে মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তার সেই স্বপ্ন লাশ হয়ে যায় সীমান্তের কাঁটাতারে ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি৷ ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের ওপর বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে তাকে ৷
কিন্তু ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কোচবিহারে বিএসএফ-এর আদালত এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে নির্দোষ ঘোষণা করে ৷ এরপর ফেলানীর বাবা ন্যায় বিচারের জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্টে যান৷ কিন্তু এখনো তার আবেদনের শুনানি শুরু হয়নি বলে জানান তিনি৷ বৃহস্পতিবার টেলিফোনে তার সাথে কথা হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে সবাই যোগাযোগ করতো, করোনা শুরুর পর কেউ আর যোগাযোগও করছে না৷ ভারত সরকার পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে শুনেছিলাম, তা-ও পাইনি৷ তবে (বাংলাদেশ) সরকারের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা পেয়েছি৷’’
ফেলানী হত্যার পর সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েই চলেছে ভারত৷ সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার করবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো৷ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে ফুল আর মিষ্টি দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় বিএসএফ সদস্যদের৷ বিএসএফ ওই দিন ‘উপহার' দিয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকের লাশ৷
মূলত চোরাচলানের কথা বলেই সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যা করা হয়৷ কিন্তু এর পিছনে বিএসএফ-এর ঘুস বাণিজ্যেরও ভূমিকা রয়েছে৷ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও একই খবর দিয়েছে৷
আর ভারতীয় গরু বা পণ্য তো সব সীমান্তে থাকে না৷ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এই গরু বা পণ্য আনা হয় সীমান্তে৷ গরু. মাদক, অস্ত্র ইত্যাদি সীমান্তে আসে কিভাবে?
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সীমান্তে মোট ৪৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ৷ এর মধ্যে ৪২ জনকে গুলি করে এবং ছয় জনকে হত্যা করা হয় নির্যাতন চালিয়ে৷ অপহরণ করা হয় ২২ বাংলাদেশিকে৷ ওই সময়ে ২৬ জন বিএসএফ-এর গুলি ও নির্যাতনে গুরুতর আহত হন৷ অপহৃতদের মধ্যে মাত্র পাঁচ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে৷ বাকিদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি৷
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে সীমান্তে বিএসএফ ৩৮ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে৷ তাদের মধ্যে ৩৩ জনকে গুলি করে এবং পাঁচ জনকে নির্যাতনে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালে সীমান্তে ১৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়৷ এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বাড়ছে৷ বাড়ছে মারণাস্ত্রের ব্যবহার৷
ভারতের মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) প্রধান কীরিটি রায় সীমান্তে হত্যার প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, চোরাচালানে যখন ঘুসের টাকা বিএসএফ পায় না, তখনই হত্যা করে৷ কেন্দ্রীয় সরকার যতই মুখে বলুক তারা আসলে কোনো ব্যবস্থা নেয় না৷
বৃহস্পতিবার কথা হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গেও৷ তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ভারত কেউই চায় না সীমান্ত হত্যা হোক৷ শুধু ভারত বা বাংলাদেশকে দোষ দিলে হবে না৷ এখানে কিছু ব্যবসায়ী আছে তারা ড্রাগ ব্যবসা করে, ফেনসিডিল আনে, গরু চোরাচালান করে৷ এরা দুই দিকেই আছে৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে বার বার অঙ্গীকার করেছে৷ বলেছে, হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে, একজনও মরবে না৷ লেথাল উইপন ব্যবহার করবে না৷ তবুও একটা দুইটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়৷
তার মনে করেন, সীমান্ত থেকে অনেক লোক আসা যাওয়া করে৷ তাদের মধ্যে দুষ্ট লোক আছে৷ তারা অস্ত্র বহন করে৷ এটা একটা সমস্যা৷’’ তার মতে, ‘‘প্রায় ক্ষেত্রে যারা মারা যায়, তারা কিন্তু বর্ডারে মরে না৷ ভারতের চার-পাঁচ কিলোমিটার ভিতরে মারা যায়৷ সেটাকে বর্ডার কিলিং কতটুকু বলা যায় আমি জানি না৷’’
বিজিবি গত বছর বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে ৭৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান পণ্য ও মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে৷ মাদকসহ নানাকিছু চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩ হাজার ৫৯৪ জনকে আটক করা হয়৷ চোরাচালানের মাধ্যমে আসা ৩৫ টি পিস্তল, ৯০ টি বন্দুক ও ১০ হাজার বিভিন্ন ধরনের গোলাবারুদও উদ্ধার করা হয়৷